মিস্টার জেপি মর্গান

মিস্টার জেপি মর্গান

 

 

: মনোয়ার রুবেল

::
ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেডের মালিকানার অন্যতম অংশীদার জেপি মর্গান চেজ এন্ড কোং। এটি কোন মুসলিম প্রতিষ্ঠান নয়, খ্রিস্টান মালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠান।

কারো মনে হয়তো প্রশ্ন হতে পারে ইসলামী ব্যাংক যদি ইসলাম প্রসারে, ঈমানি আকিদা সংরক্ষণের ব্যাংকিং হয়ে থাকে (যেমনটা সরল প্রাণ মানুষ মনে করে থাকে)   তবে তার মালিকানায় কেন ভিন্ন ধর্মাবলম্বী প্রতিষ্ঠান? প্রশ্ন হতেই পারে। তবে তার উত্তর আমরা খুঁজবো না। আমরা জেপি মর্গান চেজ এন্ড কোং নিয়ে আলোচনা করব। জেপি মর্গান শুধু বাংলাদেশই নয় সারাবিশ্বে ইসলামি ব্যাংকে বিনিয়োগ করে থাকে। বরং আমরা উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করব জেপি মর্গান কেন ইসলামি ব্যাংকিং এ বিনিয়োগ করছে।

জেপি মর্গান চেজ এন্ড কোং বিশ্বের সর্ববৃহৎ ব্যাংকিং গ্রুপ। ‘জেপি মর্গান কোং’ এবং ‘চেজ’ এই দুই প্রতিষ্ঠান শুরুতে আলাদা প্রতিষ্ঠান ছিল৷ পরে দুটো এক হয়ে নাম হয় জেপি মর্গান চেজ এন্ড কোং । বলা হয়ে থাকে, এদের সম্পদের পরিমান ব্যাংক অব আমেরিকার চেয়ে বেশী। এর প্রতিষ্ঠাতা জন পিয়েরিপন্ট মর্গান । তার নাম থেকে সংক্ষেপে জেপি মর্গান।  তিনি একজন উদ্যেক্তা, একজন ব্যাংকার, একজন শিল্পনুরাগী, একজন ধর্মপ্রাণ বিদ্যুৎসাহীও।

বিজ্ঞানী টমাস আলভা এডিসন ছিলেন জেপি মরগানের বন্ধু। মিস্টার টমাস আলভা এডিসন বৈদ্যুতিক বাল্ব, গ্রামোফোন, ভিডিও ক্যামেরা, গাড়ীর ব্যাটারী, বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রযুক্তিসহ বহু বৈদ্যুতিক সামগ্রী আবিষ্কার করেন। একজন বিজ্ঞানী আবিষ্কার করেই দায়িত্ব শেষ করেন, কিন্তু এসব পণ্য মানুষের হাতে পৌঁছাতে মার্কেটিং জানা প্রয়োজন।  একজন বিজ্ঞানীর বিপণন অভিজ্ঞতা থাকার কথা নয়। তবু টমাস আলভা এডিসন  ‘এডিসন ইলেকট্রিক কোম্পানী’ নামে একটা কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেন। ‘এডিসন ইলেকট্রিক কোম্পানী’র সব অর্থ ও বানিজ্যের পেছনে মূল হাত ছিল মিস্টার জেপি মরগানের। পরে এডিসন ইলেকট্রিক কোম্পানী রুপান্তরিত হয়ে পরে ‘জেনারেল ইলেকট্রিক’ নামে পরিচিত হয়। বর্তমানে এটি জেপি মরগান চেজ এন্ড কোম্পানীর মালিকানাধীন একটি বিশ্বখ্যাত ব্রান্ড।

ইলেক্ট্রিক পন্য ছাড়াও বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কাজও তারা করতেন। জেপি মরগান এর সর্ববৃহৎ ব্যবসা ইউনিট ছিল রেলওয়ে ব্যবসা। আমেরিকার এক তৃতীয়াংশ রেললাইন  নিয়ন্ত্রণ করতেন তিনি একাই।

ব্যাংক ব্যবসা তখনো সারা পৃথিবীতে হাউজ কেন্দ্রিক, ব্যক্তি পরিচয়ে পরিচিত।  ঢাকার জগৎশেঠ হাউজের গল্প প্রথম পর্বে আমরা বলেছি। আমেরিকাতে তেমনি ‘জেপি মর্গান’ ব্যক্তি নামেই ব্যাংক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বিনিয়োগকারী/ফাইন্যান্সর হিসেবে জেপি মর্গান এতটাই শক্তিশালী ছিলেন যে তার চেইন ভাঙতেই আমেরিকায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সৃষ্টি করা হয়। 

জেপি মরগানের সময় আমেরিকাতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধারণা সৃষ্টি হয়নি বা ধারণা থাকলেও আমেরিকাতে ব্রিটিশ-বিদ্বেষী মনোভাব প্রবল থাকায় তারা ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের আদলে কোন প্রতিষ্ঠান করতে রাজী ছিলেন না। তারা কোনভাবেই ব্রিটেনকে অনুকরন করতে চাইছিল না।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ধারণা না থাকায় যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল গভর্ণমেন্ট বেসরকারি ব্যাংকগুলো থেকে অর্থ ধার করতো। বেশ কয়েকটি মন্দার সময় জেপি মরগান আমেরিকার কেন্দ্রীয় সরকারকে লোন দিয়েছিল; বিশেষকরে ১৮৯৫ ও ১৯০৭ সালের মন্দার সময়। তখন জেপি মরগান কিছু বিনিয়োগকারীকে  নিয়ে একটি সিন্ডিকেট তৈরী করে প্রচুর সরকারী স্বর্ণমুদ্রা ও বন্ড ক্রয় করছিলো।

১৯০৭ সালে মন্দার পর একটা ধারণা তৈরী হয় এসব পুজিঁবাদীরা সরকারে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করছে। অর্থবাজারে অস্থিতিশীলতার জন্য কিছু রাজনৈতিক ও সাংসদ সরাসরি আঙ্গুল তোলেন জেপি মরগানের দিকে। ১৯১২ সালে ইউএস কংগ্রেশনাল কমিটিতে জেপি মরগানকে তলব করা হয়। এই কমিটি পুজো কমিটি নামেও পরিচিত। ওয়ালস্ট্রিট এর এলিট বিনিয়োগকারীদের সংস্থা ‘মানিট্রাস্ট’ নিয়েও  বিস্তারিত জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এরপর পুজো কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে ১৯১৩ সালে আমেরিকার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ‘ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেম’ প্রতিষ্ঠা করা হয়। এটি আজ পর্যন্ত এই নামে চলছে।

আমেরিকান কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রতিষ্ঠায় জেপি মরগান যেমন একটি ইতিহাস একইভাবে ইতিহাসের বিভিন্ন মিথেও জড়িত হয়ে আছে জেপি মরগান এন্ড কোং এর নাম। বিশ্বখ্যাত টাইটানিক জাহাজ ধ্বংসের পেছনেও জেপি মরগান জড়িত বলে একটি কনস্পাইরেসি মিথ রয়েছে।

টাইটানিক জলে নামার দুই বছর আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখা সত্বেও মিস্টার মরগান টাইটানিক ছাড়ার আগমূহুর্তে তার যাত্রার পরিকল্পনা বাতিল করেন। টাইটানিক জাহাজে জেপি মরগানের প্রতিদ্বন্দী শত্রু প্রভাবশালী বিনিয়োগকারী অস্টার, স্ট্রস, গগেনহ্যাম এই তিন বিনিয়োগকারী ব্যাংকার এর মৃত্যু কনস্পাইরেসী থিওরীর পালে বাতাস লাগায়। এছাড়া আরেকটি কারণ হচ্ছে জেপি মরগানের চিত্র সংগ্রহ এর নেশা। টাইটানিকে বিশাল একটি সংগ্রহের চালান ফ্রান্সে পাঠানোর কথা থাকলে তিনি শেষ পর্যন্ত সেগুলোও পাঠাননি বলে প্রচলিত আছে। এনিয়ে কাস্টমস কর্তৃপক্ষ তদন্তও চালিয়েছিল। যদিও সেই তদন্ত রিপোর্ট পরে আর আলোর মুখ দেখেনি। জেপি মর্গান প্রভাব খাটিয়ে সে তদন্ত থামিয়ে দেন বলে প্রচার আছে। তবে এগুলো শুধুই মিথ মাত্র।

ব্যক্তি জীবনে জনাব জেপি মর্গান বিশপশাসিত চার্চের একজন অনুসারী ছিলেন। নিউইয়র্ক চার্চ-ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন তিনি। শুধু তাই নয়, বিশ্বব্যাপী খ্রিষ্টধর্মের চার্চগুলোর মতদ্বৈততা নিরোধে বিশ্ব-সম্মেলন এর আয়োজনের জন্য তিনি উচ্ছ্বসিত ছিলেন। তৎকালীন সময়ে এ আয়োজনের জন্য একলক্ষ ডলার অনুদান দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশে জেপি মর্গান এন্ড কোং আসে ১৯৭৩ সালে। পূবালী ব্যাংকের ইউএস ডলার ডিমান্ড ডিপোজিট একাউন্ট এর মাধ্যমে তারা এদেশে প্রবেশ করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, এখন ঢাকায় জেপি মরগানের একটি অফিসও রয়েছে। 

খুব কৌতুহল হতে পারে ধার্মিক খ্রিস্টান মিস্টার জেপি মরগান এর প্রতিষ্ঠান কিভাবে ইসলামী ব্যাংকিং এ আগ্রহী হলো। একশব্দে এর সহজ উত্তর হতে পারে “ব্যবসা”। তারা দীর্ঘসময় মধ্যপ্রাচ্যে তেল ব্যবসায়ে বিনিয়োগ করছে। সত্তুরের দশকের পরেই তারা মধ্যপ্রাচ্যে ইসলামী ব্যাংকিং সেবায় আগ্রহী হয়ে উঠে। এজন্য জেপি শরীয়া ভিত্তিক গবেষণা টিম তৈরি করে। তাদের ইসলামি ব্যাংকিং ইউনিটও রয়েছে!  তাদের শরীয়া বোর্ড ও আছে!

জেপি মর্গান তাদের ওয়েবসাইট ইসলামি ব্যাংকিং বিষয়ে লিখেছে, “ ক্রমান্বয়ে প্রসারিত বাজার চাহিদা মেটাতে জেপি মরগান শরিয়া ভিত্তিক বিভিন্ন ‘পন্য’ উন্নয়ন করেছে”। অর্থাৎ তাদের উদ্দেশ্য বাজার চাহিদা মেটানো এবং বিশ্বব্যাপী একনম্বর ব্র্যান্ড হিসেবে নিজেদের ধরে রাখা। বাণিজ্যই তাদের মূল কথা।  পাপ, পুন্য, স্বর্গ, নরক বিবেচ্য নয়।

এজন্যই বোধহয় এডামস্মিথ বলেছিলেন: Business of Business to do Business. (কারবারের কাজকারবারই হলো কারবার)

[লেখকঃ মনোয়ার রুবেল।  প্রধান সম্পাদক,  “শুক্রবারের বিশেষ লেখা”। কাজ করেছেন  বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে। লিখছেন একদশকেরও বেশি সময়৷ বর্তমানে বি.ওয়াপদা কর্পোরেট শাখা, ঢাকায় সিনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন।]