দ্য ব্যাংকিং জায়ান্ট

দ্য ব্যাংকিং জায়ান্ট

তুহিন খন্দকার
::
পৃথিবীর বৃহত্তম ব্যাংক কোনটি?  সোনালী ব্যাংকার্স এর দেয়ালে কেউ কেউ আবেগে বা অজানায় লিখেন সোনালী ব্যাংক লিমিটেড পৃথিবীর বৃহত্তম ব্যাংক!  আসলেই এই গ্রহের সবচেয়ে বড় ব্যাংক কোনটি? এর শাখা কয়টি? কত লোকইবা কাজ করে?  এমন আগ্রহ যেকোন ব্যাংকারের হতে পারে। 
 
 
ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না,  সংক্ষেপে  “আইসিবিসি”  চীনের একটি বহুজাতিক ব্যাংকিং কোম্পানি। ব্যাংকটি চীনের রাষ্ট্রমালিকানাধীন চারটি ব্যাংকের একটি। মোট সম্পদের হিসাবে এটি বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব্যাংক বলে স্বীকৃত।
 
সারাবিশ্বের ব্যাংকিং খাতের গভীর বিশ্লেষণ, সুচিন্তিত মতামত ও স্কলারদের স্বাক্ষাৎকার সমৃদ্ধ বিখ্যাত ম্যাগাজিন “দ্য ব্যাংকার” এর বিবেচনায় সেরা ব্যাংকের তালিকায় এক নম্বরে আছে আইসিবিসি।
 
 
যুক্তরাজ্যভিত্তিক বিশ্বখ্যাত এই ম্যাগাজিনটি ব্যাংকিং খাতের বিভিন্ন তথ্য বিশ্লেষণ এর অন্যতম বৃহৎ উৎস। যার মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী ব্যাংকগুলোর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তথ্য জানা যায়। সামর্থ্য ও সক্ষমতার দিক বিবেচনায় এনে ‘দ্য ব্যাংকার’ ১৯৭০ সাল থেকে প্রতি বছর বিশ্বের সেরা ১০০০ ব্যাংকের তালিকা তৈরি করে থাকে। এবছর অর্থাৎ ২০২০ সালে তাদের এ কার্যক্রমের ৫০ বছর পূর্তির বছরে সারাবিশ্বের খ্যাতনামা ব্যাংকগুলোর নিরীক্ষাকৃত আর্থিক বিবরণীর চুলচেরা বিশ্লেষণ করে তৈরি করা র‌্যাংকিং এর শীর্ষস্থানে রয়েছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না ।  টায়ার-১ ক্যাপিটাল বিবেচনায় দ্যা ব্যাংকাররের দৃষ্টিতে প্রথম পাঁচটি ব্যাংক হচ্ছে ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না, চায়না কনস্ট্রাকশন ব্যাংক, এগ্রিকালচারাল ব্যাংক অব চায়না, ব্যাংক অব চায়না ও জেপি মরগান চেজ। 
 
২০১৫ সালে টায়ার-১ ক্যাপিটাল ভিত্তিতে একমাত্র বাংলাদেশী ব্যাংক হিসেবে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ ৯৫৪ তম অবস্থান নিয়ে সেরা ১০০০ ব্যাংকের তালিকায় ঢুকে পড়েছিল। ২০২০ এ উপমহাদেশের সর্ববৃহৎ ব্যাংক হিসেবে ২৪০০০ শাখা নিয়ে স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া বিশ্ব র‍্যাংকিং এ ৫৭ নম্বরে আছে৷ 
 
 
২০০৯ সাল থেকে পেশাভিত্তিক সেবায় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান প্রাইস ওয়াটারহাউজ কুপারস (পিডব্লিউসি) বিশ্বের প্রতিযোগিতাপূর্ণ কোম্পানিগুলোর মধ্যে বাজার মূলধনের হিসেবে সেরা ১০০টির তালিকা তৈরি করে আসছে। লন্ডনভিত্তিক এ প্রতিষ্ঠানটির এবছরের মার্চ মাসের তালিকায় আইসিবিসিকে ১৭তম প্রতিযোগিতাপূর্ণ কোম্পানি বলা হলেও ফোর্বস ম্যাগাজিনের ২০২০ সালের পরিসংখ্যানে বিশ্বের ২,০০০ ব্যাংকের মধ্যেও শীর্ষস্থানে আছে চায়নার এ ব্যাংকটি। ফোর্বসের র‌্যাংকিং তথ্য অনুযায়ী প্রায় ৪০০০ বিলিয়নেরও বেশি সম্পদের মালিক এই ব্যাংকটি তার শীর্ষস্থানে আছে অষ্টমবারের মতো।
 
 
বিশ্বের ব্যাংকিং এর র‍্যাংকিং এ রাজত্ব করা আইসিবিসি প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে চীনা কমিউনিস্ট পার্টির নাম। ১৯৭৮ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত চীনা কমিউনিস্ট পার্টির ১১তম কেন্দ্রীয় কমিটির তৃতীয় নিয়মিত অধিবেশনের পর চায়নার পুনর্গঠন শুরু হয়৷  এসময় চীনের কেন্দ্রীয় ব্যাংক  ‘পিপলস ব্যাংক অব চায়না (পিবিসি)’র পক্ষে যুগপৎভাবে আর্থিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও আর্থিক খাতের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে কাজ করাটা সাংঘর্ষিক হয়ে দাঁড়ায়। তাই আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলির পুনর্গঠন ও পিবিসি’র কাজের বিকেন্দ্রিকরণের দাবি ওঠে। ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বরে স্টেট কাউন্সিল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে পিবিসি শুধু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভূমিকা পালন করবে এবং আইসিবিসি প্রতিষ্ঠা করা হবে শিল্প ঋণ এবং সাধারণ ব্যাংকিং কার্যাবলী পরিচালনা করার জন্য, যা পূর্বে পিবিসি করতো।
 
 
এরই প্রেক্ষিতে নিবিড় পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তুতির পর ১৯৮৪ সালের ১ জানুয়ারি চীনের একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ও বিশেষায়িত বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে  ইন্ডাস্ট্রিয়াল এন্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না বা আইসিবিসি’র অানুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়। আইসিবিসি কে ২০০৫ সালে কোম্পানিতে রুপান্তর করা হয়। সরকারি মালিকানাধীন ব্যাংক হলেও ২০০৬ সালে সাংহাই স্টক এক্সচেঞ্জ-এ শেয়ার বিক্রির জন্য এর তালিকাভুক্ত হয়। 
 
 
বর্তমানে আইসিবিসি’র কর্মী সংখ্যা প্রায় সাড়ে চার লক্ষেরও অধিক।  কর্পোরেট গ্রাহক গ্রাহক ৮০,৯৮,০০০  এবং সাধারন গ্রাহক প্রায় ৬৫০ মিলিয়ন। ব্যাংকটির অভ্যন্তরীন শাখার সংখ্যা ১৭,০০০ (২০১৮)। এছাড়া ৪১টি বিদেশী শাখা আছে।
 
 
চায়নার বাইরে লুক্সেমবার্গ, প্যারিস, আমস্টার্ডাম, ব্রাসেলস, মিলান, মাদ্রিদ, বার্সেলোনা, ওয়ারশ ও লিসবনসহ ইউরোপের সব শহরে আইসিবিসির শাখা আছে। আপাতদৃষ্টিতে চায়না আমেরিকা বিরোধ হলেও আমেরিকায় ২০০৮ সালে চায়নার রাষ্ট্রায়ত্ত এই ব্যাংকটি শাখা স্থাপনের অনুমোদন পায়। নিউইয়র্ক সিটিতে দ্বিতীয় কোনও বিদেশি ব্যাংক হিসেবে তারা শাখা খোলে। উপমহাদেশে পাকিস্তানের করাচি এবং ইসলামাবাদে দুটি শাখা আছে। 
 
 
২০১৪ সালটা ছিল আইসিবিসি’র জন্য একটি মাইলফলক। এ বছরই ‘দ্য ব্যাংকার’ এর তালিকায় সেরা ১০০০ ব্যাংকের মধ্যে শীর্ষস্থান লাভ করে ব্যাংকটি। বিস্তৃতির এ ধারাটি সে ২০১৫ সালেও ধরে রাখতে সক্ষম হয়। এ বছর মধ্যপ্রাচ্য ও ইউরোপে তার ব্যাংকিং পরিধি বিস্তৃত করে।
 
আইসিবিসি তার বিকাশ, কৌশল ও পরিচালন কার্যক্রমের পাশাপাশি সামাজিক দায়বদ্ধতামূলক কাজগুলোও সচেতনভাবে করে থাকে। তৃণমূল পর্যায়ে দরিদ্র মানুষদের জন্য ত্রাণ কার্যক্রম চালানোর পাশাপাশি পরিবেশ ও সম্পদ রক্ষা এবং জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে ব্যাপক স্বীকৃতি অর্জন করেছে। আইসিবিসি মূল ব্যবসায়ের সাথে প্রকৃত অর্থনীতির সেবা দেওয়ার অন্তর্নিহিত লক্ষ্যটি সবসময় মাথায় রাখে।
 
বৈশ্বিক করোনা মহামারীতেও পিছিয়ে নেই ব্যাংকিং খাতের জায়ান্ট হিসেবে খ্যাত আইসিবিসি। সম্প্রতি তারা করোনা মহামারীর মন্দা মোকাবেলার জন্য তিন বছরের কৌশলগত পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
 
 
কৌশলগত পরিকল্পনা অনুযায়ী ব্যাংকটি প্রথমত, তিনটি বড় প্রকল্প নিয়ে কাজ করবে। সেগুলো হলো ক্রেডিট ম্যানেজমেন্টের পুনর্গঠন, নন-পারফর্মিং ঋণের সংকোচন এবং এন্টারপ্রাইজ ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার উন্নতি। 
দ্বিতীয়ত, সম্পদ,দায়, উপার্জন এবং চ্যানেল এই চারটি বিষয়ে নতুন বাজার ও নতুন ধরণের ব্যবসার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে নতুন একটি অপারেশন কাঠামো তৈরি করবে। 
 
তৃতীয়ত, নতুন সুদের হারকে সামনে রেখে ব্যাংকটি আইটি-ভিত্তিক ব্যাংকিং, খুচরা ব্যাংকিং, কর্পোরেট ব্যাংকিং, বড় সম্পদ ব্যবস্থাপনা, ইন্টিগ্রেশন, এবং আন্তর্জাতিকীকরণের পাঁচটি ক্ষেত্রে অভিনব রূপান্তর প্রক্রিয়া বাস্তবায়ন করবে। সেসঙ্গে স্থিতিশীল মুনাফা বৃদ্ধির জন্য কৌশলগত ভিত্তি প্রণয়ন করবে। 
 
চতুর্থত, ব্যাংকটি তাদের রূপান্তর ও উন্নয়নের জন্য  প্রাতিষ্ঠানিক গঠন প্রক্রিয়াকে  গভীরভাবে সংস্কার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
 
আইসিবিসি বিশ্বাস করে যে, করোনা মহামারীর মন্দা কাটিয়ে উঠতে এই নতুন ত্রিবার্ষিক পরিকল্পনাটি তার ভবিষ্যতের পরিচালন উন্নয়নের জন্য কৌশলগত দিকনির্দেশনা ও চালকের ভূমিকা পালন করবে এবং এই পরিকল্পনা অনুসরণ করে ব্যাংকটি তার রূপান্তর ও বিকাশকে নতুন স্তরে উন্নীত করবে।
 
 
যেহেতু ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড কমার্শিয়াল ব্যাংক অব চায়না ব্যাংকিং জায়ান্ট তাই তাদের কর্মপরিকল্পনা যে কোন ব্যাংকের জন্য দর্শন হতে পারে। বিশ্বব্যাপী ব্যাংকগুলো মহামারীজনিত মন্দা হতে উত্তরণের জন্য মুখিয়ে আছে বলাই বাহুল্য। আইসিবিসির ত্রিবার্ষিক পরিকল্পনা অন্যদের সিদ্ধান্তগ্রহন প্রক্রিয়ায় কতোটা সহায়ক হবে তা সময়ই বলে দিবে। 
 
 
[ লেখকঃ মো. আরেফিন আলম (তুহিন খন্দকার)। কাজ করেছেন গোলাম মোর্তোজা সম্পাদিত ‘সাপ্তাহিক’ এ। দৈনিক সমকাল, বণিক বার্তায় কাজকরা সহ বেশকিছু আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ম্যাচ কাভার করা এই সাবেক গণমাধ্যম কর্মী বর্তমানে কর্মরত আছেন হিলি স্থলবন্দর সংশ্লিষ্ট হাকিমপুর শাখা দিনাজপুর এ।]