ব্যাংকার থেকে লেখক

ব্যাংকার থেকে লেখক

– রাহাতুল রাফি
::
বলিউডের বহুল আলোচিত ‘থ্রি ইডিয়টস’ সিনেমাটি অনেকের প্রিয় সিনেমার তালিকায় রয়েছে । তুমুল জনপ্রিয় এই সিনেমা ‘চেতন ভগত’ নামের একজন বিখ্যাত লেখকের উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত হয়েছে। চেতন প্রকাশ ভগত ভারতের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত বইয়ের লেখক। ২০০৮ সালের টাইম ম্যাগাজিনের  বিশ্বের একশত ক্ষমতাধর ব্যক্তির তালিকায় ছিলেন তিনি।
 
ঔপন্যাসিক ছাড়াও তিনি একজন চিত্রনাট্যকার, একজন নিবন্ধকার, একজন বক্তা। ভারতের সবচেয়ে জনপ্রিয়তম এ লেখক একজন ব্যাংকারও।  বর্তমান সময়ে যেসব ব্যক্তি ‘ফ্রম ব্যাংকার টু রাইটার’ হিসেবে খ্যাতিমান তার তালিকায় মিস্টার ভগত তালিকায় প্রথমেই আছেন। 
 
১৯৯৭ সালে এমবিএ শেষে একজন ব্যাংকার হিসেবে তিনি কাজ শুরু করেন গোল্ডম্যান সাক্স এর সাথে। গোল্ডম্যান সাক্স এ কাজ করতে গিয়ে ম্যানেজার এর আচরণ ভীষণ অপছন্দ হয় তার। বাজে, খিটখিটে ও অবিবেচনা প্রসুত আচরণ ছিল ম্যানেজারের। অন্য কোন আয়ের উৎস না থাকায় চাকুরি ছাড়তে পারছিলেন না৷ বিরক্ত ও ক্ষুদ্ধ চেতন ভগত ম্যানেজার এর চরিত্রকে ভিলেন হিসেবে কল্পনায় রেখে  ‘ওয়ান নাইট এট কল সেন্টার’ নামে উপন্যাস লিখতে শুরু করেন।  
 
চেতন প্রকাশ ভগত বলেন, “আমি লেখা শুরু করেছিলাম পরিবর্তন আনতে”।  ‘ওয়ান নাইট এট কল সেন্টার’ বইটি তার ভাগ্যেরও পরিবর্তন নিয়ে আসে। এটা তাকে তুমুল জনপ্রিয়তা এনে দেয়।  ২০০৫ সালে এই বই তিন দিনে পঞ্চাশ হাজার কপি বিক্রি হয়। এটিকে ভারতের দ্রুততম সময়ে বেস্ট সেলিং উপন্যাস বলা হয়। 
 
 
তিনি গোল্ডম্যান সাক্স ছেড়ে পরে যোগ দেন ডাচেস ব্যাংকে। ২০০৯ সালে ১২ বছর দীর্ঘ  ব্যাংক জীবন ছেড়ে লেখালেখিকে পুর্ণ পেশা হিসেবে নেন মিস্টার ভগত। 
 
 
ব্যাংকিং একটি ‘কাট-খোট্টা’ পেশা হলেও চেতন ভগতের মতো অনেকেই ব্যাংকে বসে লেখালেখির মতো সুকুমার বৃত্তির চর্চা করেছেন। ব্যাংক চাকুরি বলতে একসময় গল্প-উপন্যাস না হলেও লেখালেখি, তথা কেরানীগিরিকে বোঝাতো৷ এজন্যই বোধহয় কেরানীর ইংরেজি প্রতিশব্দের তালিকায় ‘রাইটার’ শব্দটিও রয়েছে! 
 
 
আরেকজন ব্যাংকার হলেন বিখ্যাত কবি  টি,এস ইলিয়ট। কবি ইলিয়ট ১৯৪৮ সালে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পান৷ তিনি  লন্ডনের  লয়েডস ব্যাংক এর ক্লার্ক ছিলেন। কাজ করতেন বৈদেশিক হিসাব ব্যবস্থাপনা বিভাগে। ব্যাংক ট্যুরে প্যারিস গিয়ে তার দেখা হয় আরেক খ্যাতিমান লেখক-কবি জেমস জয়েস এর সাথে। সেখানে লেখক জয়েস টি,এস ইলিয়টের কবিতা লেখার হাত নিয়ে কটাক্ষ করেন। ইলিয়ট এতে ক্ষিপ্ত হয়ে  লেখালেখির প্রতি যেন আরো দৃঢ় হয়ে উঠেন।  যদিও জয়েস এর সাথে স্বাক্ষাতের আগেই ‘দ্য লাভ সং অব জে আলফ্রেড প্রুফ্রক’ কবিতার মাধ্যমে ব্যপক পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। কবি খ্যাতি পাওয়ার পরেই পরেই তিনি ব্যাংক চাকুরী নেন৷ 
 
 
 
কবি টিএস ইলিয়টের অনুরক্ত ছিলেন বাংলা ভাষার  নোবেলবিজয়ী কবি শ্রী রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি ইলিয়ট দ্বারা বেশ প্রভাবিত ছিলেন বলাই বাহুল্য। ইলিয়টের অনুবাদ করেছেন প্রচুর। তবে রবীন্দ্রনাথের মাথায় ব্যাংকিং এর ভূত কোথা থেকে এসেছে জানা নাই। ১৯০৫ সালে পতিসরে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর “কালী গ্রাম কৃষি সমবায় ব্যাংক” নামে একটি ব্যাংক চালু করেন৷ এর আগে ২৭ ডিসেম্বর, ১৯০৪ সালে কবি ৬০০০ টাকা প্রথম আমানত জমা রাখেন৷ শুধু তাই নয়, নোবেল পুরষ্কার এর একটি বড় অংশ ( তখনকার পরিমানে প্রায় এক লাখ বিশ হাজার টাকা) এ ব্যাংকে তিনি জমা রাখেন। 
 
 
 
বলা যায় বাংলার প্রথম কৃষি ব্যাংকের ধারণা রবীন্দ্রনাথেরই। এটি ‘পতিসর কৃষি সমবায় ব্যাংক’ নামেও পরিচিত ছিল৷ ব্যাংক থেকে ১২%  হারে ঋণ নিতো কৃষকরা৷ তহবিল সংকটের জন্য আটআনা হারে ধারকর্জ করে ব্যাংক তহবিল যোগান দিতেন কবি।  ব্যাংকটির যখন ভরাডুবি হলো তখনো রবীন্দ্রনাথ কৃষকদের দোষ দেননি।  তিনি মনে করতেন ইংরেজদের একটি ভুল আইনের জন্য তার ব্যাংকের ভরাডুবি হয়। ‘পিতৃস্মৃতি’তে কবি তা উল্লেখ করেছেন৷ মজার বিষয় হচ্ছে এই ব্যাংকের জমা খরচের হিসাব এখনো সংরক্ষিত আছে। 
 
 
 
চেতন প্রকাশ ভগতের পর গোল্ডম্যান সাক্সের আরেক ব্যাংকার এ্যাইফ্রিক ক্যাম্পবেলও একজন বেস্ট সেলার লেখক। যুক্তরাজ্য ভিত্তিক এই আইরিশ লেখিকা ২০১২ সালে ‘অন দ্যা ফ্লোর’ উপন্যাসের জন্য অরেঞ্জ এওয়ার্ডের সংক্ষিপ্ত তালিকায় ছিলেন। ২০২১ সালে তার ‘দ্যা লাভ মেকারস’ নামে উপন্যাস প্রকাশমান। এই প্রখ্যাত লেখিকাকে সাবেক ব্যাংকার পরিচয়  বেশিই তাড়িয়ে বেড়ায়। তিনি তার ব্যক্তিগত ব্লগে লিখেছেন, “যেকোন স্বাক্ষাৎকারে তার ব্যাংকার জীবনই সাংবাদিকদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকে”। তারা জানতে চায় একজন ব্যাংকার কিভাবে লেখক হয়ে উঠে৷  ব্যাংকার পরিচয়কে মানুষ এতটাই অসৃজনশীল মনে করেন যে বারবার বিস্ময়সূচক প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়।  মিস ক্যাম্পবেল তার ব্লগে লিখেছেন এই প্রশ্নে তিনি এতটাই হাঁপিয়ে উঠেন সম্ভব হলে জীবন থেকে ব্যাংকার হওয়ার অংশটুকু মুছে দিতেন।
 
 
 
ব্যাংকার থেকে বিখ্যাত আরেক লেখক ও’হেনরী। ও’হেনরির জীবনে ব্যাংকিং নাটকীয়তায় ভরা৷ 
 
 
তিনি ছিলেন ন্যাশনাল ব্যাংক অব অস্টিন এর ক্যাশিয়ার ও বুককিপার। কিন্তু  খামখেয়ালীপনা ও লেজার লিখতে অলসতার কারণে ব্যাংকের চাকুরি হারান। তার বিরুদ্ধে লেজার মিলাতে গিয়ে গরমিলের কারণে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ উঠে। মামলার ভয়ে হন্ডুরাস পালিয়ে গিয়ে এক ভয়ঙ্কর ট্রেন ডাকাতের কাছে আশ্রয় নেন।  তার এই বন্ধুকে নিয়ে পরে ‘ক্যাবেজ এন্ড কিং’ নামে একটি জনপ্রিয় বইও লিখেন৷ 
 
 
 
কবি ও লেখক ও’ হেনরি পালিয়ে থাকার চেয়ে একসময়  আত্মসমর্পণ করাকে বেশী যুক্তিযুক্ত মনে করেন। ব্যাংক অব অস্টিনের ক্যাশিয়ার থাকাকালে ৮৫৪ ডলার ৮ পয়সা (পেনি)  আত্মসাতের অভিযোগে তার পাঁচ বছর জেল হয়৷ জেলে থাকা অবস্থায় তিনি বিভিন্ন ছদ্মনামে চৌদ্দটি গল্প লিখেন। “ও’ হেনরি” নামটি তখন জনপ্রিয় হয়। তার আসল নাম ছিল উইলিয়াম সিডনি পোর্টার। 
 
 
ব্যাংকার পেশা তার জন্য আশির্বাদ ছিল নাকি অভিশাপ তর্কসাপেক্ষ।  
 
 
বাংলা ভাষায় কেরানী থেকে লেখক হওয়ার নজির থাকলেও ব্যাংকার থেকে লেখক হওয়ার নজির কম। বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গর্ভনর লুৎফর রহমান সরকার ব্যাংকার পরিচয়ের পাশাপাশি ছড়াকার হিসেবেও পরিচিত ছিলেন। কিন্তু সেটাকে ব্যাংকার পরিচয়ের উর্ধ্বে নিয়ে যেতে পারেন নি।  কিন্তু পাশের দেশ ভারতেই অর্জুন চরন হেমব্রম, রবিলাল টুডু, রভি সুব্রামানিয়ামসহ অনেকে ব্যাংকার পরিচয়কে ছাপিয়ে লেখক হিসেবে স্বনামে খ্যাত হয়েছেন। ২০১৩ সালে ভারতের ‘সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার’ পান ওড়িশার লেখক অর্জুন চরণ হেমব্রম। ২০১৫ সালে একই পুরস্কার পান পশ্চিমবঙ্গের সাঁওতালি সাহিত্যিক রবিলাল টুডু। 
 
 
লেখক তার লেখায় বিভিন্ন চরিত্র নির্মাণ করেন। নিজের ইচ্ছের রংতুলিতে কিছু চরিত্র এক সুঁতোয় গেঁথে গল্প তৈরী করেন। গল্প পাঠকের মনে দাগ কাটে। পাঠক বুঁদ হয়ে থাকে অপার মুগ্ধতায়। এই লেখায় শুধু তেমন কয়েকজন ব্যাংকারের গল্প বলতে চেয়েছি৷ তারা ব্যাংকিংয়ের পাশাপাশি লেখালেখির মতো সৃজনশীল কাজেও স্বাক্ষর রেখেছেন। সফল হয়েছেন৷ অনুকরনীয়  হয়েছেন। 
 
 
[লেখক: রাহাতুল রাফি।  ছাত্রজীবনে সাংবাদিকতার হাতেখড়ি।  কাজ করেছেন দৈনিক কালের কন্ঠে কন্ট্রিবিউটর ফিচার রাইটার  হিসেবে। ২০২০ সালে একুশের বইমেলায় ‘জোনাকির গান’ নামে একটি গল্পগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে৷ টিভি নাটকের স্ক্রিপ্ট রাইটিং এবং পরিচালনায়ও কাজ করা রাহাতুল রাফি বর্তমানে অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন কেন্দুয়া শাখা, নেত্রকোনায়।]