ব্যাংক ইন এ বক্স

ব্যাংক ইন এ বক্স

:: ফারজানা আফরোজ শিখা
 
::
মাহিনের ঘোড়াগুলির একটি বহুল প্রচলিত গান “পৃথিবীটা নাকি ছোট হতে হতে,  ড্রয়িং রুমে রাখা বোকা বাক্সতে বন্দি”। এই বোকাবাক্সগুলো বোকা না থেকে সচল হয় আপনার, আমার নির্দেশ মতো। সেটা ড্রইং রুম হোক অথবা রাস্তার আনাচে কানাচে। 
 
ঘরে বসে ই-বে, আমাজান, আলীবাবায় চাপ দিলেই পণ্য হাজির হয়। ফুডপান্ডায় ক্লিক  করলেই খাওয়ার হাজির হয়।  এসব নিত্য নতুন আইডিয়ার স্রোতে ব্যাংকও সেবা-বিবর্তনের নানান রুপ নিয়ে হাজির হয় নিয়মিত।
 
আর তাই পৃথিবীর মত ছোট হতে হতে ব্যাংকও এখন বাক্স বন্দি হয়ে পড়েছে। ‘ব্যাংক ইন এ বক্স’  তেমনই একটি বক্স যাকে বলা যায় বাক্সবন্দি একটি শাখা। সপ্তাহে সাত দিন চব্বিশ ঘন্টা সবসেবা ধারণার স্মার্ট নাম ব্যাংক-ইন-এ-বক্স। টাকা তোলা, টাকা জমা, হিসাব খোলা, অনলাইন ট্রান্সফার সবই হতে পারে বাক্সের সামনে । বিষয়টা জানতে ইতিহাস ঘুরে আসি।
 
৫০ বছর আগে স্কটল্যান্ডের অধিবাসী জন শেফার্ড ব্যারন চকলেট ভেন্ডিং মেশিন (চকলেট বিক্রি করার স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র) দেখে ভেবে বসলেন ATM তৈরির কথা। যেমন ভাবনা তেমন কাজ। ১৯৬৭ সালের ২৭ জুন লন্ডনে বার্কলেস ব্যাংকের এনফিল্ড শাখায় একটি এটিএম মেশিন বসান তিনি। তখন এটি দিয়ে শুধু টাকা উঠানো যেত। এটাকে প্রথম সফল এটিএম মেশিন বলা হয়। 
 
এর আগে আমেরিকায় সিটিব্যাংক  ব্যাংকোগ্রাফ নামে এটিএম মেশিন বসালেও ছয় মাসের মাথায় পাবলিকের দাঙাহাঙ্গামায় সেটি বন্ধ করে দেয়া হয় ঠিক মতো কাজ করছিল না বলে৷ তখন পর্যন্ত এটিই ছিল বাক্স বন্দি ব্যাংকিং সেবা। 
 
কিন্তু মানুষ তো আর বসে থাকার নয়। ভাবতে থাকে আরও কি কি করলে সহজ হবে ব্যাংকিং।  ভাবতে ভাবতেই তৈরি করে ফেললো Interactive Teller Machine( ITM)। অনেকটা এটিএম এর বড় ভাইয়ের মত আবির্ভূত হল আইটিএম। যেহেতু বড় ভাই তার দায়িত্বও বেশি। আইটিএম এর মাধ্যমে শুরু হলো অর্থ উত্তোলন করা, নগদ জমা করা,  চেক জমা দেওয়া, ঋণ এর অর্থ প্রদান  স্থানান্তর করা ইত্যাদি নানানরকম কাজ। গ্রাহকদের সহায়তা করার জন্য প্রয়োজনে  ভিডিও কলে একজন ব্যাংকার ডিজিটাল পর্দায় উপস্থিতও হয়ে যান।  এভাবেই শুরু হয় ব্যাংকিং বিবর্তনের নতুন অধ্যায় ‘ব্যাংক ইন এ বক্স’।
 
‘ব্যাংক ইন এ বক্স’ এটিএম এর মতোই দেখতে একটি মেশিন বা কম্পিউটার।  গ্রাহক এর সামনে গিয়ে দাঁড়ালে মেশিনটি এক্টিভেট হয়। কম্পিউটার পর্দায় একজন কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজার বা ব্যাংকার সরাসরি ভিডিও কলে কাস্টমারের সাথে যুক্ত হন৷ আপাত মনে হবে আপনি তার কাছ থেকে সরাসরি সেবা নিচ্ছেন। একাউন্ট খুলতে চাইলে পর্দায় টাচ স্ক্রিনে ফিঙারপ্রিন্ট দেয়াসহ সব সুযোগই থাকে। 
 
এ বিবর্তনের প্রথম ব্যাংক ছিল যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্য টেনেসির টাওয়ার কমিউনিটি ব্যাংক। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্রযুক্তির মাধ্যমে  ব্যাংকার ও গ্রাহকের দূরত্ব কমিয়ে ব্যাংক সেবা দেয়ার প্রত্যয় নিয়ে তারা আইটিএম চালু করে ।  আইটিএম এর মাধ্যমে এগিয়ে নিতে থাকে তাদের ব্যাংক কার্যক্রমকে। বর্তমানে  বারোটি মেশিন  নিয়ে এ ব্যাংকের বেশ কিছু শাখা প্রত্যন্ত এলাকায় ব্যাংকিং পরিচালনা করছে এবং বেশ সফল ভাবেই করছে। 
 
আইটিএম দিয়ে সাফল্যের মুখ দেখা আরেকটি ব্যাংক হলো ফিলাডেলফিয়ার সিটিজেন ব্যাংক। ব্যাংকের মার্কেটিংয়ের ভাইস প্রেসিডেন্ট জ্যাকি  হেস্টার বলেন, “আমরা আমাদের কাস্টমারদেরকে প্রযুক্তি ব্যবহার করে যত সহজতর উপায়ে সম্ভব ব্যাংকিং সিস্টেমে প্রবেশ নিশ্চিত করে সেবা দিতে চাইছি”।  সিটিজেন ব্যাংকও চারটি আইটিএম/এটিএম দ্বৈত মেশিন দিয়ে এ যাত্রা শুরু করেছে এবং আরও কুড়িটি মেশিন চালু করার পরিকল্পনা তাদের রয়েছে।  
 
এ প্রযুক্তিতে সাধারণ মানুষের উৎসাহ দেখে বিশ্বের অনেক ব্যাংক তাদের শাখায় আইটিএম চালু করছে।
 
সেলওয়ের পার্ক ব্যাংক, এনজে একটু দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য এনে কলিংউডে একটি শাখা খুলেছিল ২০১৬ সালে৷ শাখাটি এমনভাবে সাজিয়েছিলো যে আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে আপনি একটি কফিশপে এসেছেন।  এতে দুর্দান্ত সাফল্য পায় তারা। মনে হয়, শাখা নিজেই তার গ্রাহকদের হাত বাড়িয়ে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। কোনও ক্যাশের লাইন নেই,  হইচই নাই, কাউন্টারে কাউন্টারে  আইপ্যাড আছে,  ফ্রি ওয়াই-ফাই আছে এবং ব্যাংকে চায়ের ব্যবস্থা আছে। গ্রাহকরা ইচ্ছা করলে আইপ্যাড থেকে ভিডিও কলে কোন ব্যাংকার এর সাথে আলাপ করে লেনদেন করতে পারেন। মনে হবে তারা কফি খেতে খেতে একটি বাক্সের সাথে লেনদেন করছেন।
 
ডাইম কমিউনিটি ব্যাংকের বেডফোর্ড অ্যাভিনিউ শাখা খুলতে গিয়ে প্রায় একই রকম ধারনা নিয়ে এগিয়েছিল তারা।   ডাইম ব্যাংকের মতে, “যে সব গ্রাহকরা একটু বসে এক কাপ কফি পান করা এবং কোনও ব্যাংকারের সাথে কথা বলা, এসব চান, এ শাখা সেই সুযোগটিও করে দিয়েছে।” সেখানে টেবিলে ট্যাবলেট রাখা থাকে। কেউ ইচ্ছে করলে নিজের কম্পিউটার বা মোবাইল থেকে ব্যাংক স্পেসে এসে নেটওয়ার্কে যুক্ত হতে পারে। কফি খেতে খেতে কারো সাহায্য ছাড়াই ব্যাংকিং করে চলে যেতে পারেন। যদি কেউ মনে করে,  একাকীত্বে ভুগছেন তখুনি ভিডিও কলে ভার্চুয়ালি কোন ব্যাংকারের সাথে যুক্ত হতে পারেন।
 
বিবিসি প্রকাশিত ‘নগদের ভবিষ্যৎ : ব্যাংক ইন এ বক্স কি শাখার বিকল্প হতে পারে?’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে  এটিএম প্রস্তুতকারী বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান এনআরসি এর বরাত দিয়ে বলছে, শাখায় হয় এমন আশিভাগ লেনদেনই অনায়াসে মেশিনে সম্পন্ন করা যায় । বিবিসি তাদের প্রতিবেদনে বলছে, ভারত রাশিয়া, ব্রাজিল  চায়না এই চারটি দেশে ব্যাংক ইন এ বক্সের সম্ভাবনা প্রচুর। 
 
 
ব্যাংক ইন এ বক্স শিক্ষিত ও শহুরে লোকের সেবা মনে করা হলেও ভারতীয় উদ্যেক্তা, আইডিএফসি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও সিইও ড. রাজীব লাল ভারতীয় গ্রামীণ মানুষের ক্ষমতায়নের উপায় হিসেবে ব্যাংক ইন এ বক্স কে বেছে নিয়েছেন৷ ভারতে আইডিএফসি  ব্যাংক গ্রাম পর্যায়ে ‘মাইক্রো-এটিএম’ নামে ব্যাপকভাবে ‘ব্যাংক ইন এ বক্স’ সেবা চালু করেছে। এর সাফল্য পাচ্ছেন প্রশ্নাতীত!   দেখাদেখি ভারতের অন্য ব্যাংকগুলোও এখন এ সেবায় ঝুঁকছে৷ প্রশ্ন হতে পারে, প্রায় সম আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশে এর সম্ভাবনা কতটুকু?
 
বাংলাদেশে এই ধারণা গ্রহণের এখনই উপযুক্ত সময় বলে মনে করে, এই প্রকল্পটি বাংলাদেশের ডিজিটাল ডিভাইস ইনোভেশন এক্সপো ২০১৯ এ একটি সম্ভাব্য আইটি পণ্য হিসাবে প্রদর্শিত হয়েছিল।  দুই তরুণ মাহবুবুল ওয়াসেক এবং মাশরুর ওয়াসেক যৌথভাবে এতে কাজ করেন। এক্সপোতে বলা হয়েছিল, এই প্রকল্প  কেবলমাত্র ব্যাংকিংকে নিরাপদই করবে না বরং বাংলাদেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ডিজিটালাইজিং করা, ভিডিও কনফারেন্সিং এজেন্ট এবং ব্যাংকারদের কার্যকারিতাসহ কিওস্ক মেশিনগুলি আর্থিক সেবা প্রদানে ব্যক্তির সরাসরি উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করে।  মেশিনের মাধ্যমে  ব্যাংকিং চলবে। মেশিনের  টাচ স্ক্রিনে আঙ্গুলের ছাপ সংগ্রহের সুবিধা, নতুন একাউন্ট খোলা, ছবি তোলা এবং ডিজিটাল কলমে স্বাক্ষরসহ নানান সংযোজন একটি বাক্সকে রুপ দিবে ব্যাংকের শাখায়।
 
এটিএম চালুর ৫০ বছর পূর্তি উৎযাপন করেছে বিশ্ব। এই পঞ্চাশ বছরে ‘লেনদেনের বাক্স’কে মানুষ তার মেধা আর উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে একটি শাখার বিকল্প হিসেবে দাঁড়  করিয়েছে।  সামনের সময়গুলোও আমাদের।  নানান প্রতিকূল পরিবেশকে নিজেদের বেঁচে থাকার উত্তম এবং সহজীকরণ কেবল মানুষের পক্ষেই সম্ভব। সব কিছুকে ছাপিয়ে জয় হোক মানবতার। জয়ী হই আমরা সবাই।
 
[লেখিকাঃ ফারজানা আফরোজ শিখা। একজন সাংগঠনিক মানুষ, শিখা এর আগে ফিচার রাইটার হিসেবে কাজ করেছেন চারবেলা চারদিক ম্যাগাজিনে। কাজ করেছেন অনু বিজ্ঞান পত্রিকায় এবং রেডিও টুডে’তে। বর্তমানে প্রিন্সিপাল অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন বৈদেশিক বাণিজ্য কর্পোরেট শাখা, ঢাকায়]