মনোয়ার রুবেল
::
অনেকে আঁতকে উঠেন ঢাকায় চৌষট্টিটি ব্যাংক শুনে। প্রশ্ন করেন, অপেক্ষাকৃত ছোট নগরে এত ব্যাংক কেন? ঢাকা ব্যাংকের নগরী, অনেকে ভুলে যান। শুধু সংখ্যায় নয়, ইতিহাস ও ঐতিহ্যে ঢাকায় ব্যাংকিং এর গল্প প্রাচীন। ভারতীয় উপমহাদেশের ব্যাংক ব্যবসার তীর্থভূমি ঢাকা৷ আরো সহজভাবে বললে, বাংলাতেই ভারতবর্ষের ব্যাংক ব্যবসার জন্ম, বেড়ে ওঠা ও তারুণ্যপ্রাপ্তি।
সে একসময় বাংলাজুড়ে মারোয়াড়ীদের আনাগোনা ছিল৷ মারোয়াড়ীরা কাজ করত মূলত বিনিয়োগকারী হিসেবে, হালের ফ্যাইন্যান্সিং ফার্মগুলোর মতোই। ১৭০০ সালের আগে ঢাকাতে এমন বেশকিছু হাউজ ছিল এমন ; সাতুরমুরা খান হাউজ, রামদুলালবোস হাউজ, বলরাম ঘোষ হাউজ, গোপাল দাস, কৃষ্ণচরণ দাস, শিবনাথ দাস, মনোহর দাস, শিবপ্রসাদ দাস ও কিশোর দাস। এ হাউজগুলোর মধ্যে সুদের কারবার করা ছাড়াও ব্যাংক হিসেবে প্রভাবশালী হয় ‘দ্যা জগৎশেঠ হাউজ’।
বৃটিশ লেখকগণ ‘দ্যা জগৎশেঠ হাউজ’কে তুলনা করেন ব্যাংক অব ইংল্যান্ডের সাথে। ব্যাংক অব ইংল্যান্ড বৃটিশ সরকারের হয়ে কাজ করত, দ্যা জগৎশেঠ হাউজ কাজ করতো বাংলার নবাবের হয়ে। দুটোর পার্থক্য হচ্ছে, এটি একটি ব্যক্তি মালিকানাধীন হাউজ, অন্যদিকে ‘ব্যাংক অব ইংল্যান্ড’ সরকারি মালিকানাধীন। ঢাকার ব্যবসায়ী মানিক চাঁদ জগৎশেঠ হাউজের প্রতিষ্ঠাতা।
মানিক চাঁদ মারা যান ১৭১৪ সালে। এরপর উত্তরাধিকার সূত্রে ছয় পুরুষ জগৎশেঠ হাউজ পরিচালনা করেন। চাঁদ পরিবার হয়ে উঠে শেঠ পরিবার। শেঠ শব্দের অর্থ ব্যাংকার। বংশের বড় পুত্র হাউজের প্রধান হিসেবে ‘জগৎশেঠ’ পদবী ব্যবহার করতেন। ব্যাংকে এখন যেমন ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা চেয়ারম্যান পদবি আছে, এটিও তেমনই। এটি ”জগৎশেঠ হাউজ নামে পরিচিত হলেও এর অফিশিয়াল নাম ছিল “দ্যা হাউজ অব জগৎশেঠ”।
ইতিহাসে জগৎশেঠ বাঙালিদের কাছে এক ঘৃণ্য ভিলেন। সিরাজউদদৌলা যাত্রায়, নাটকে, সিনেমায় তার চরিত্র নেতিবাচক। ১৭৫৭ সালে পলাশির যুদ্ধের খরচাপাতি ছাড়াও বিভিন্নপক্ষকে ম্যানেজ করার জন্য দায়িত্ব নিয়েছিল জগৎশেঠ ৷ এই যুদ্ধে নবাবকে অপসারণের জন্য তিনকোটি টাকার চুক্তি করে ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে। সেই যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দোলা হেরে যান। ব্রিটিশ সেনাপতি লর্ড ক্লাইভ তার বইয়ে বাংলা জয়ে জগৎশেঠ এর ভূমিকা কৃতজ্ঞতাভরে তিনি উল্লেখ করেছেন। সে অবশ্য অন্য গল্প।
সতেরশো সতকে জগৎশেঠ ছিল ভারতের সবচেয়ে ধনী পরিবার। তারা ঢাকা, কলকাতা ও মুর্শিদাবাদ; এই তিন অফিসের মাধ্যমে সমগ্র ভারতে ব্যবসা পরিচালনা করতো। দিল্লীসহ সব বড় রাজ্যে শাখা অফিস ছিল। বাংলাদেশে গ্রাম পর্যায়েও “লোন অফিস” ছিল। গ্রামে ক্ষুদ্র, মাঝারী ও দীর্ঘ মেয়াদে তারা ঋণ দিত। সুদের হার ছিল ৪০% থেকে ৫০%!
উইলিয়াম ড্যারিম্পল এর ‘’দ্য এনার্কি: দ্য রিলেন্টলেস রাইজ অব দ্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি” বইতে লিখেছেন, ‘দ্যা জগৎশেঠ হাউজ’ এর কাছ থেকে বছরে গড়ে প্রায় চার লক্ষ টাকা পরিমান ঋণ নিতো ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানী! ঋণগ্রহীতার তালিকায় নবাব ছিলেন। দিল্লির সম্রাটও ছিলেন।
ব্যাংকিং কার্যক্রম এর অংশ হিসেবে ‘দ্যা জগৎশেঠ হাউজ’ বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময়ের কাজ করতো। শুধু বৈদেশিক মুদ্রা নয় স্থানীয় মুদ্রা ভাঙানোও বিরাট ঝামেলার বিষয় ছিল তখন। সে সময় বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে ৫২ ধরণের মুদ্রা প্রচলিত ছিল। তখন টাকা বা রুপী ছিল না। রুপী নামকরণ হয় ১৮৩৬ সালে। ১৭৮৪ সালে ঢাকা কালেক্টরেট ম্যাথিউ ডে লিখেছেন তখন ঢাকার প্রধান মুদ্রার নাম ছিল আর্কট। বিসশানু, সাহরদার, মাদ্রাজ, সুরাট, বেনারসসহ বহুনামে আর্কট ছিল। জগৎশেঠ হাউজ এক আর্কট অন্য আর্কটে রুপান্তর/বিনিময় করে দিতেন। বৃটিশদের স্বর্নমুদ্রা রৌপ্য এই হাউজে দেশীয় মুদ্রায় বিনিময় করা হতো, দেশীয় মুদ্রাকে বিদেশি মুদ্রায়ও রুপান্তর করতো।
জগৎশেঠ এর ব্যবসায় কতো বড় ছিল তার একটা ধারণা দেয়ার চেষ্টা করা যাক। আগেই বলা হয়েছে বাংলার নবাবেব প্রধান ব্যাংক ছিল ‘দ্যা জগৎশেঠ হাউজ’। নবাবের হয়ে তারা রাজস্ব আদায়, শুল্ক আদায়, সাহায্য প্রদান, সরকারি কেনাকাটা এসব করত। শুধু বাংলারই নয়, বিহার উড়িষ্যা, পাটনা এদের হয়েও এই হাউজ কাজ করতো। তাদের খাজনা হাউজে জমাও থাকতো।
কোন জমিদার নবাবের কাছে বার্ষিক জামানত রাখতে ব্যর্থ হলে তাদের হয়ে এ হাউজ জামিনদার হতো। আধুনিক জমানার কখনো গ্যারান্টার কখনো ট্রাস্ট রিসিপ্ট কাজ করে দিত। দিল্লীর সম্রাটের কাছে অনেক নবাবের গ্যারান্টর হয়ে নবাবী টিকিয়ে রাখতে সাহায্য করতেন। জগৎশেঠ হাউজের বার্ষিক নীট মুনাফা ছিল গড়ে ৩০- ৪০ লক্ষ টাকা। বর্তমান মূল্যে প্রায় পাঁচ হাজার কোটি টাকার সমান৷
১৭২০ এ ভারতজুড়ে দুর্ভিক্ষ শুরু হলে বিভিন্ন রাজ্যে অর্থসংকট দেখা দেয়। জগৎশেঠ হাউজ দিল্লী অফিসের মাধ্যমে সম্রাটের অর্থ বিভিন্ন জায়গায় দ্রুত সময়ে স্থানান্তর (মানি লন্ডারিং) করেন৷ সম্রাটের ধারণা এর মাধ্যমে দুর্ভিক্ষ কমিয়ে আনা সম্ভব হয়। দিল্লী অফিস থেকে অন্য অফিসে একটি চিঠা লিখে দেওয়া হতো। সাথে সাথে সেই অফিস টাকা পরিশোধ করতো। বর্তমানে ব্যাংক ড্রাফটের সাথে তুলনা করা যায়। দ্যা জগৎশেঠ হাউজ’ এর ব্যাংকিং প্রক্রিয়ায় সম্রাট মাহমুদ শাহ বিস্মিত হয়ে ১৭২৩ সালে জগৎশেঠ বা ‘বিশ্বব্যাংকার’ উপাধি দেন। এর আগে এর নাম ছিল নগরশেঠ।
‘দ্যা জগৎশেঠ হাউজ’ এতটাই স্বচ্ছল ছিল যে, বর্গি অর্থাৎ মারাঠারা আক্রমন করে সে সময়ের ৩০-৪০ লাখ টাকা লুট করে নিয়ে গেলেও এতে ব্যাংক ব্যবসায়ে কোন প্রভাব পড়েনি। একই সময়ে ইংরেজরা দ্যা হিন্দুস্তান ব্যাংক খুললেও তাও ‘দ্যা জগৎশেঠ হাউজ’ এর কাছে অসহায় হয়ে পড়ে। পরে তারা দ্যা বেঙ্গল ব্যাংক নামেও একটি ব্যাংক খুলে।
সমগ্র ভারতের সবচেয়ে প্রভাবশালী এই আর্থিক প্রতিষ্ঠান ১৭৫৭ সালে বাংলার নবাবের বিরোধিতা করেন। ‘দ্যা জগৎশেঠ হাউজ’ বাংলা ও উত্তরভারতের প্রায় সব নবাবের ব্যাংক হিসাব রক্ষা করতেন এবং তাদের সবারই গোপন রাজনৈতিক খবরাখবর জানতেন। এসব খবরাখবর কখনো ব্যবসায়ের স্বার্থে প্রভাব খাটাতেন। আলীবর্দি খান এর নাতি সিরাজউদ্দৌলা বাংলার নবাব হলে রাষ্ট্রীয় বিষয়ে দ্যা জগৎশেঠ হাউজ এর নাক গলানো বন্ধের উদ্যেগ নেন। এই উদ্যোগ তৎকালীন হাউজ প্রধান মহাতপ চাঁদ ভালোভাবে নেননি। ১৭৫৭ সালেন ২৩ই জুন ইস্ট-ইন্ডিয়া কোম্পানীর সাথে মিলে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন।
কিন্তু তাদের এই আনন্দ বেশীদিন টিকেনি। কিছুদিন পর দ্যা জগৎশেঠ হাউজ এর শুভাকাঙ্খী লর্ড রবার্ট ক্লাইভ ভারত ছেড়ে গেলে বাংলার নবাব মিরকাশেম এর তোপের মুখে পড়ে পুরো হাউজ। ১৭৬৩ সালে দ্যা জগৎশেঠ হাউজ এর প্রধান ফতেহ চাঁদ ও চাচাতো ভাই স্বরুপ চাঁদকে হত্যা করেন নবাব মির কাশেম। এর মধ্য দিয়ে বাংলা তথা ভারতের সবচেয়ে শক্তিশালী আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পতন হয়। সুযোগ বুঝে, হাউজের সম্পত্তি অধিগ্রহন করে নেয় ইংরেজ সরকার।
[ লেখকঃ মনোয়ার রুবেল। প্রধান সম্পাদক, “শুক্রবারের বিশেষ লেখা”। কাজ করেছেন বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে। লিখছেন এক যুগের বেশি সময়৷ বর্তমানে সিনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন।]