সুরাইয়া হোসেন
::
‘ট্রেজারি‘ শব্দের ভালো বাংলা প্রতিশব্দ হয় ‘ধনভান্ডার’। ট্রেজারি ম্যানেজমেন্টকে বাংলায় বলতে পারেন ধনভান্ডার ব্যবস্থাপনা৷
অনেক সময় এমন হাজারো প্রশ্ন আসে, ব্যাংক আমানতকারীদের অর্থ পরিচালনা করে, ব্যাংকের জমাকৃত অর্থ পরিচালনা করে কে? ব্যাংক ব্যবসার মূলধন কোথায় বিনিয়োগ করতে হবে এবং কতটা রিজার্ভ রাখতে হবে এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত কে নিবে? শাখাগুলোতে প্রচুর অলস টাকা পড়ে থাকে। বিভিন্ন ব্যাংক মেইন অফিস হিসাব/ জেনারেল হিসাব/ হেড অফিস হিসাব ভিন্ন ভিন্ন নামে এসব হিসাবের স্থিতি হিসাবায়ন করে। এসব টাকায় সুদ দেয়া হয় কেন্দ্রীয়ভাবে। এই টাকা কী করা হয়, কোথায় বিনিয়োগ করা হয়, এসব টাকার উপর সুদের যোগান হয় কিভাবে হয়, এটা প্রধান কার্যালয়ের লস কিনা, এমন অসংখ্য প্রশ্ন #নতুন_ব্যাংকারদের মনে আসে। যারা এসব সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া সম্পর্কে অবগত নন এমন অনেক পুরনোদের মনেও এসব প্রশ্ন আসতে পারে।
সব প্রশ্নের উত্তরের জন্য #ট্রেজারি_অপারেশন পাঠ অত্যন্ত জরুরী। প্রত্যেক আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ধনভান্ডার পরিচালনার জন্য ‘ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট ডিভিশন’, ট্রেজারি অপারেশন” নামে আলাদা বিভাগ থাকে৷ ট্রেজারিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ধমনী বলাও বাহুল্য হবেনা।
ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় জমাকৃত অলস স্থিতির হিসাব ট্রেজারি ডিভিশন সংরক্ষণ করে এবং এই টাকা বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করে থাকে। বিনিয়োগ ছাড়া ট্রেজারিকে যে কাজটি করতে হয় তা হলো CRR ও SLR সংরক্ষণ। ব্যাংক কোম্পানী আইনের ২৫ ধারা অনুযায়ী বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত হারে ব্যাংকগুলো তাদের আমানতের বিপরীতে নগদ জমা সংরক্ষণ করতে হয়৷ এটাকে সি.আর.আর বলে। এর মাধ্যমে ব্যাংকগুলোর নিজেদের তারল্য বজায় রাখা নিশ্চিত হয় পাশাপাশি এ প্রক্রিয়ায় বাজারে নগদ প্রবাহের নিয়ন্ত্রন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক৷ বাজারে নগদ টাকার প্রবাহ বাড়াতে কেন্দ্রীয় ব্যাংক সি.আর.আর হার কমিয়ে দেয়৷ আবার বাজারে নগদ টাকা বেড়ে গেলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এর হার বাড়িয়ে দেয়। ব্যাংকগুলো তখন নগদ টাকায় লাগাম টেনে ধরে। সিআরআর এর জন্য ব্যাংকগুলোকে বেশি হারে প্রভিশন রাখতে হয়৷ এই পুরো কার্যক্রমে ট্রেজারি অপারেশন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাহায্য করে । বর্তমানে সি.আর.আর হার ৪%। তারল্য বজায় রাখতে বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রিন্সিপাল একাউন্টে CRR (নগদ সংরক্ষণ হার) হিসেবে সংরক্ষণ করা এবং SLR (বিধিবদ্ধ তরল জমা) হিসেবে বর্তমানে ১৩% আমানত জমা রাখতে হয়।
একইভাবে অনেক সময় যেকোন ব্যাংক তারল্য সংকটে ভুগতে পারে। যেহেতু এই লেখা নতুনদের জন্য তাই ‘তারল্য’ শব্দ যারা বুঝতে পারছেন না তাদের জন্য বলি। তারল্য হল হাতে থাকা নগদ টাকা। অনেক সময় শাখায় চেক নিয়ে গিয়ে গেলে দেখা যায় ব্যাংক চেকের বিপরীতে গ্রাহককে নগদ টাকা দিতে পারছে না। এমন অবস্থাকে ব্যাংকের ভাষায় তারল্য সংকট বলে। কোন ব্যাংক যখন তারল্য সংকটে পড়ে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত সুদ হারে কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে এক রাতের জন্য অন্য কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে নগদ ধার নিতে পারে। এর নাম হচ্ছে কল মানি। কলমানি ট্রেজারির আয়ের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম।
কলমানি ছাড়াও টাকা ধার নেয়ার আরেকটি মাধ্যম হচ্ছে রিপো, মানে রি-পারচেজ এগ্রিমেন্ট অর্থাৎ এখন বিক্রি করছি কিন্তু পুনরায় কিনে নেব এই শর্তে বিক্রয়। স্বাভাবিকভাবে কম দামে বিক্রি করে পরে বেশি দামে কিনে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয় রিপোতে। ব্যাংকে সাময়িকভাবে নগদ টাকার চাহিদা বেশি হলে এসএলআর হিসেবে রক্ষিত ইন্সট্রুমেন্ট বিক্রি বা একদিনের জন্য বন্ধক দিয়ে দিয়ে নগদ টাকা নিয়ে নেয়া হয়। ধার গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট ডিলিং রেটে সুদ প্রদান করে থাকে।
রিপোর ঠিক উল্টো প্রক্রিয়া রিভার্স রিপো। অর্থাৎ এখন ক্রয় করছি কিন্তু পুনরায় বিক্রি করে দিব এই শর্তে। রিভার্স রিপোও ট্রেজারির আয়ের আরেকটি মাধ্যম।
এতো গেল অন্য আর্থিক প্রতিষ্ঠান হতে ধার করার উপায়। তারল্য সংকট দেখা দিলে ব্যাংক থেকে তহবিল গ্রহণ করে আপাত তারল্য সংকট মোকাবেলা করা যায়। এমন আরেকটি পদ্ধতি হচ্ছে এএলএস ( Assured liquidity support)। বিগত দুই মাসের মধ্যে প্রাইমারি মার্কেট থেকে ক্রয়কৃত ট্রেজারি বিল ও ট্রেজারি বন্ডের লিয়েনের মাধ্যমে নিৰ্দিষ্ট অনুপাতে ও নির্দিষ্ট সুদহারে বাংলাদেশ ব্যাংক হতে তহবিল গ্রহণ সুবিধাই হচ্ছে ALS। প্রাইমারি ডিলার ব্যাংকসমূহ (বর্তমানে ২১ টি) বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এই বিশেষ তহবিল সুবিধা পেয়ে থাকে।
এগুলো ট্রেজারি অপারেশনের মাধ্যমে তারল্য সংকট মোচনের গল্প। এবার যদি ভান্ডার ব্যবস্থাপনার বিনিয়োগ বা আয়ের দিকটি বলি তবে প্রথমেই ট্রেজারি বিলের কথা আসে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে বিভিন্ন মেয়াদি সরকারী টি-বিল ক্রয় করা যায়। সরকার স্বল্পকালীন বাজেট ঘাটতি টি-বিল ইস্যু করে। এইসব বিল সাধারণত ১৪ দিন, ৯১ দিন, ১৮২ দিন এবং ৩৬৪ দিন মেয়াদী হয়ে থাকে। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকে নিলামের মাধ্যমে বেচা কেনা হয়। শুধু প্রাইমারী ডিলাররাই (পিডি) এতে অংশগ্রহণ করতে পারেন। তবে নন পিডি কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান এতে অংশ নিতে চাইলে তাকে কোন পিডির মাধ্যমে বিড করতে হবে। এটা সেকেন্ডারি মার্কেটেও বেচাকেনা করা যায়। মেয়াদ ভেদে বিলের ক্ষেত্রে বর্তমানে ২.৩১% – ৪.৬১% চলছে, তবে এই সুদের হার প্রতি অকশনেই পরিবর্তিত হয়ে থাকে।
শেয়ার ও ডিবেঞ্চার কেনা বেচার ছাড়াও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ফান্ড প্লেসমেন্ট (এফডিআর) নামে একটি বিনিয়োগ উপায় রয়েছে৷ আমরা যেরকম গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এফডিআর দিয়ে থাকি, ঠিক সেরকমই ট্রেজারি ডিভিশন বিভিন্ন ব্যাংক ও নন-ব্যাংক প্রতিষ্ঠানকে কর্তৃপক্ষ কর্তৃক অনুমোদিত সুদহারে নির্দিষ্ট মেয়াদে ফান্ড প্লেসমেন্ট খাতে টাকা বিনিয়োগ করে থাকে।
আবার সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন মেয়াদের ট্রেজারি বন্ড অকশনে বাজারে ছাড়ে। ট্রেজারি বিল স্বল্প মেয়াদের জন্য বিনিয়োগ সুবিধা অন্যদিকে বন্ড দীর্ঘমেয়াদে বিনিয়োগ সুবিধা দেয়। বিভিন্ন ব্যাংক ট্রেজারি বন্ড ক্রয় করার লক্ষ্যে অকশনে অংশগ্রহণ করে। এভাবে ট্রেজারি ডিভিশন তার ব্যাংকের পক্ষে অকশনে জিতে ট্রেজারি বন্ড ক্রয় করে থাকে। ট্রেজারি বন্ডের মেয়াদ ২-২০ বছর হতে পারে। বন্ডের ক্ষেত্রে প্রায় ৭.৮০% – ৯.১০% হার পর্যন্ত মুনাফা প্রদান করা হয়।
কোন আর্থিক প্রতিষ্ঠান তার Tier-ll ক্যাপিটাল বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে বাজারে সাব-অর্ডিনেটেড বন্ড ছাড়ে এবং বিভিন্ন ব্যাংকে সেই বন্ড ক্রয়ের জন্য আহবান জানায়। কোন ব্যাংক যদি মনে করে এই বন্ড ক্রয় করবে তখন তার ব্যাংকের পক্ষে ট্রেজারি পর্ষদের অনুমোদন সাপেক্ষে বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক অনুমোদিত সুদ হারে ৫ থেকে ৭ বছর মেয়াদে উক্ত বন্ড ক্রয় করে থাকে। এটা বিনিয়োগের একটি আকর্ষণীয় মাধ্যম।
এইগুলো ছাড়াও ট্রেজারি অপারেশন ALM ও ALCO সংক্রান্ত কার্যাবলী, ব্যাংকের ডিপোজিট ও ঋণের সুদের হার নির্ধারণ, RTGS এবং নগদ ব্যবস্থাপনা সেলের মাধ্যমে BACH এর লেনদেনসমূহ মনিটরিং, সর্বোপরি ব্যাংকের সিনিয়র ম্যানেজমেন্ট টিমকে মার্কেটের পরিস্থিতি অবহিতকরণ, তহবিলের সমস্যা, বিনিয়োগের উপর রিটার্ন, নগদ-সম্পর্কিত ঝুঁকি এবং অনুরূপ বিষয়ে প্রতিবেদন অবগত করে।
ভবিষ্যৎ বাজারের যেকোন চাপ রোধে ব্যাংক-কে প্রতিযোগীতায় সামর্থ্যবান হিসেবে নিশ্চিত করার জন্য ট্রেজারি বিভাগ নিবিড় ভাবে কাজ করে থাকে। ব্যাংকের ধনসম্পদ যথোপযুক্ত বিনিয়োগ ও ব্যবস্থাপনার জন্য এই কার্যক্রমকে ব্যাংকের হার্টও বলে থাকে।
এখানে প্রত্যেকটি পয়েন্ট একেকটি বিশদ গল্প হতে পারে। যেহেতু এই লেখা #নতুনদের_জন্য, তাই সবিস্তারে না গিয়ে একটা চিত্র তুলে ধরার প্রয়াস ছিল । অতি সংক্ষেপে বলা এ অংশটি মূলত ট্রেজারির স্থানীয় (অভ্যন্তরীণ) অংশ। এছাড়া আরেকটি অংশ বৈদেশিক বাণিজ্য নিয়ে কাজ করে। যার মাধ্যমে বহির্বিশ্বের সাথে লেনদেন, তথা বানিজ্য সংঘটিত হয়। সে অংশটি সমুদ্রসম বিস্তৃত।
(লেখকঃ সুরাইয়া হোসেন। ২০০৯ সালে যোগদান করা এ প্রিন্সিপাল অফিসার বর্তমানে কর্মরত আছেন ট্রেজারি ম্যানেজমেন্ট ডিভিশন, প্রধান কার্যালয়। ব্যাংকের বাইরেও নানা সাংগঠনিক কর্মকান্ডে যুক্ত এ সংগঠক সোনালী ব্যাংকার্স এর কোর-সংগঠক ও অনলাইন এডমিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।)