শায়লা শারমিন::
আমার বাবা ছিলেন সোনালী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা। জ্ঞান হবার পর থেকে দেখেছি বাবা সকাল সাড়ে আটটায় অফিসে যায় আর সাড়ে পাঁচটায় বাসায় আসে। তখন তো মোবাইল ছিল না, তাই দশ পনেরো মিনিট দেরি হলেই আমার মা বারান্দায় উদ্বিগ্ন মুখে দাঁড়িয়ে থাকত। আমিও মায়ের সাথে দাঁড়িয়ে থাকতাম। ভয়ংকর রকম অসুস্থ না হলে , বাবা অফিস বাদ দিতো না। আমাদের পাড়ায় ওনার কিছু কলিগ ছিলেন। ওনারা সকালবেলা নিচতলা থেকে ডাকতেন , ”খোন্দকার সাহেব!!খোন্দকার সাহেব!!”
তারপর একসাথে অফিসে যেতেন।
আমাদের বাসায় ছোট একটা ছেলে থাকতো। ওর নাম সোহেল । সোহেল সবাইকে গর্ব করে বলত,
-আমগো খালু সোনালিলি ব্যাংকে কাম করে!!
সোনালি বলতে পারত না, তাই সোনালিলি!!
যাই হোক, কিছুদিন পর আমি পাড়ার ইস্ট এন্ড টিউটোরিয়াল ছেড়ে পাড়া থেকে একটু দূরে লক্ষীবাজার সেন্ট ফ্রান্সিস স্কুলে ভর্তি হলাম। অন্য মেয়েদের সাথে রিকশায় যেতাম। প্রথম প্রথম যেতে ভয় পেতাম। বাবা অফিস আর মা স্কুলের চাকরির জন্য সাথে যেতে পারত না। তাই বাবা বলল,
-শোন, ভয় পাবার কিছু নেই। ভয় পেলে অথবা রাস্তা হারিয়ে ফেললে তোর কাছে যে সোনালি ব্যাংক পাবি , সেখানে চলে যাবি। যেয়ে বলবি, আমার বাবা সোনালি ব্যাংক যেখানে শাপলা আছে, সেখানে কাজ করে। ওরা আমাকে ফোন করবে আর আমি ছুটে তোকে নিয়ে আসব। আছে ?
আমি মাথা নাড়িয়ে বললাম,
-ঠিক আছে !!
এরপর থেকে এখন পর্যন্ত নতুন কোন জায়গায় গেলেই মনের অজান্তেই সোনালি ব্যাংক খুঁজি। সেদিন থেকে এখন পর্যন্ত এই ব্যাংক আমার ভরসার স্থান হয়ে আছে।
আমি যখন ক্লাস সিক্সে পড়ি , বাবার পোস্টিং হলো মানিকগন্জে। প্রতি সপ্তাহের ছুটিতে এসে পরদিনই চলে যেতে হতো। আমার খুব মন খারাপ হলো। কিন্তু বাবা বলল,
-মন খারাপ করিস কেন!আমিতো সবসময় আসছি। আর তোর একটা বেড়ানোর জায়গা হলো। বাসাটা ঠিক মতো গুছিয়ে নেই, তারপর এসে তোকে নিয়ে যাব।
একদিন স্কুল থেকে এসে যথারীতি খাবার নিয়ে ঝামেলা শুরু করে দিলাম। মা কখনো আমাকে মারতো না। সেদিন কেন যেন দিলো পিঠে দু’ঘা বসিয়ে দিলাম । আমি কান্নার বদলে অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম। তারপর ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললাম,
-বাবা বাসায় নেই বলে তুমি আমাকে মারলে?আমি থাকবো না তোমার সাথে। এখনই বাবার কাছে চলে যাব।
মা বিরক্ত হয়ে বলল,
-যা বাপের মেয়ে, বাপের কাছে যা!!আমাকে আর জ্বালাস না!!
আমি চোখ মুছে একটা পলিথিনে দুইটা জামা, একটা তোয়ালে নিলাম। আমার ছোট্ট একটা নীল বালিশ ছিল, যেটা ছাড়া ঘুমাতে পারতাম না। সেই বালিশ নিতে চাইলাম, কিন্তু ব্যাগ ছোট হওয়াতে নিতে পারলাম না। আর নিলাম আমার সন্চয় মোট ছয় টাকা। সব গুছিয়ে রওয়ানা দিলাম বাবার কাছে , মানিকগন্জ !!
জানি না কিভাবে যাব!!তবে বাবা যেমন বলেছে মতিঝিল শাপলার কাছে সোনালি ব্যাংকে যেয়ে বলব, আমাকে বাবার কাছে যেতে চাই। ওনারা নিশ্চয়ই নিয়ে যাবে।
ইস্ট এন্ড ক্লাব পার হতেই ভাইয়ার এক বন্ধুর সাথে দেখা। এই এক যন্ত্রনা। পাড়ার মোড়ে মোড়ে, হয় ভাইয়া নয় মামাদের কোন না কোন বন্ধু থাকবেই।
ভাইয়ার বন্ধু জিজ্ঞেস করল,
-কি ব্যাপার ?তুমি এদিকে কোথায় যাচ্ছ ?
কারন ওনারা জানে আমার ঘুরে বেড়ানোর গন্ডি কতটুকু!!আজকে গন্ডি ছাড়িয়ে একটু বেশি দুরে চলে এসেছি। বললাম,
-মানিকগন্জ যাই।
সে ভুরু কুঁচকে বলল,
-খালা জানে তুমি যাচ্ছ ?
আমি বললাম ,
-না!!
সে বলল,
-চলো বাসায়। খালাকে বলে আবার যেও।
এরপর আমাকে বাসায় পৌঁছে দিয়ে এলো!!
এইসব ভাইয়াদের জ্বালায় কিছু করার উপায় নেই। সব মা’কে রিপোর্ট করবে!!যত্তসব!
মা তো সব শুনে অবাক !!আমাকে আর কিছু না বলে রাতে বাবাকে ফোন করে জানালো।
এরপরের সপ্তাহে বাবা এসে বলল,
-এবার যাবার সময় তোকে সাথে নিয়ে যাব। আমার মেয়েকে মেরেছে। এতো বড় সাহস!!
আমি তো মহাখুশি!!কিন্তু বাবা বলল,
-তুমি সারাদিন অফিস করবে। ও যেয়ে কি করবে?
বাবা জানালো যে ওনার একজন কলিগ আছে, ওনার ছেলেমেয়েরা আমার সমবয়সী। দিনে আমি তাদের বাসায় থাকবো, রাতে বাবা নিয়ে আসবে।
যেমন কথা তেমন কাজ !!
বাবার সাথে রওয়ানা দিলাম মানিকগন্জ । ছোটখাট সুন্দর একটা শহর!!আন্টির বাসায় সবাই খুব আদর করলো !!কত কিছু খাওয়ালো। আন্টির মেয়ের সাথে খুব বন্ধুত্ব হয়ে গেলো।
পরদিন বাবাকে খুব জরুরি কাজে ঘিওর যেতে হবে। আসতে রাত হবে। আমাকে জিজ্ঞেস করলো,
-কিরে যাবি আমার সাথে ?
আমি লাফিয়ে উঠলাম। অবশ্যই যাব!!
সকালে উঠে দেখি আসলেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার স্যাপার। ব্যাংকের সামনে বেশ বড় একটা জীপ দাঁড়িয়ে আছে। ব্যাংকের ভেতর থেকে বড় বড় তালা দেওয়া একটা বিশাল ট্রাংক আনা হয়েছে। দু’জন বন্দুকওয়ালা পুলিশ ও আছে।
আমি ভয় পেয়ে ফিসফিস করে বললাম,
-বাবা, ট্রাংকের ভেতরে কি?
বাবা বলল,
-এর ভেতরে অনেক টাকা। আমরা ঘিওর ব্রান্চে নিয়ে যাব। সাথে পুলিশ যাবে।
আমি আর বাবা গাড়ির সামনে বসলাম । পেছনে বিশাল ট্রাংকসহ দু’জন পুলিশ!!
এই ছোট্ট জীবনে নিজেকে আর কখনোই এতো গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়নি!!
এরপর দু’দিন ছিলাম। আন্টি আর চাচাদের আদরে খুব ভালো সময় কাটলেও রাতে মায়ের জন্য কাঁদতাম। তারপর চোখ মুছে ভাবতাম, ভালো হয়েছে। এখন একা একা থাকো!!মারলে কেন আমাকে??!!
পঁচানব্বই সালে আমার এস এস সির রেজাল্ট বের হলো। আমি সব বিষয়ে লেটার সহ স্টার মার্কস নিয়ে পাশ করলাম। আমাদের ফোন ছিল না। মা নানাবাড়ী নিয়ে গেলো আব্বুকে ফোন করার জন্য । ফোনটা তালা দেয়া থাকতো নানার ঘরে। নানাকে ফোন করার কারন জানাতে হতো । তারপর নানা বিরক্ত মুখে তালা খুলে দিয়ে বলতেন , -কথা শর্ট করো!!অনেক বিল উঠে যায়।
যাই হোক, আমার ইচ্ছা ছিল বাবাকে প্রথম রেজাল্ট জানাবো। কিন্তু ফোন করলে তো নানাকে কারন জানাতে হবে।
নানার ঘরে যেয়ে মা বলল,
-নানাকে সালাম করো। বলো তোমার রেজাল্ট কি?
আমি সালাম করে অনিচ্ছা সত্তেও রেজাল্ট বললাম।
নানা অবাক হয়ে বললেন ,
-সব বিষয়ে লেটার মানে আশি পারসেন্ট ?
ইংলিশ আর বাংলাতেও?
আমি বললাম ,
-জ্বি!সবগুলোতে!!আমি বাবাকে ফোন করবো।
নানা বিরক্ত হয়ে ফোনের তালা খুলতে খুলতে বললেন,
-বাংলাতেও লেটার?আমাদের সময় চল্লিশ পেতেও কস্ট হতো। এখনকার শিক্ষা ব্যবস্থার কি যে হাল কে জানে!!
যাই হোক, ফোন করে জানালাম।
বাবা খুশিতে সেদিন হাফ অফিস করে অনেক মিস্টি নিয়ে বাসায় এলো।
এখন পর্যন্ত আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ দিন ‘সেইদিন’!!
তখনকার সময়ে শিক্ষা বোর্ডগুলোতে মেধা তালিকা দেয়া হতো বিশতম স্থান পর্যন্ত । বিশতম স্থানের নম্বর থেকে আমার তিন নম্বর কম ছিল। বাবা সবাইকে বলতো , আমার মেয়ে ঢাকা বোর্ডের তেইশতম। ওরা প্লেস দেয়নি তো কি হয়েছে?? আমি দিলাম।
এরপরে জানতে পারলাম, সোনালী ব্যাংক এমপ্লয়ার বেনেভলেন্ট ফান্ড থেকে যাদের ছেলেমেয়েরা এস এস সি আর এইচ এস সি তে ভালো ফলাফল করেছে, তাদের পুরস্কার দেবে। প্রথম তিনজনকে গোল্ড মেডেল দিবে। আমি তিনজনের মধ্যে একজন নির্বাচিত হয়েছি। যাদুঘর মিলনায়তনে অনুষ্ঠান করে মেডেল দেয়া হবে। বাবা খুব আনন্দিত !!তার মেয়ে গোল্ড মেডেল পাবে। কিন্তু সবকিছু প্রস্তুত করতে ওনাদের প্রায় বছর দুয়েক লেগে গেলো । ততদিনে আমি কলেজে আর বাবা রিটায়ার করেছে।
আটানব্বই সালে বাবার সাথে গেলাম যাদুঘর মিলনায়তনে। ব্যাক স্টেজে লাইনে দাঁড়ানো আমি শুনলাম ঘোষনা, “এবার পুরস্কার নিতে আসছে অবসারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা খোন্দকার মসলেহউদ্দীন আহমেদের কন্যা শায়লা শারমীন!!”
এই প্রথম ভালো ফলাফলের থেকেও বাবার মেয়ে হবার জন্য খুব গর্ব হলো। মাথা উঁচু করে স্টেজে যেয়ে প্রধান অতিথি সামনে দাঁড়ালাম। উনি আমাকে গোল্ড মেডেল পরিয়ে দিলেন । করতালিতে মুখরিত হলো মিলনায়তন। অল্প আলোতে বাবাকে দেখা যাচ্ছিল না। কিন্তু আমি জানি বাবার হাততালি সবাইকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। বাবার মোটা চশমার পেছনে গর্বের অশ্রু !!
এর ঠিক পরের বছর বাবা আমাদের ছেড়ে চলে যায়।
তাকে গর্বিত করার সুযোগ আমরা দু’ভাইবোন আর পাইনি।
ইংল্যান্ডে আসার পর আমার বর জিজ্ঞেস করলো যে আমি প্রথমে কি দেখতে চাই?
আমি বললাম, বিগ বেন!!বিবিসি লন্ডন রেডিওতে যে ঘড়ির টুংটাং শব্দে রোজ ভোর ছ’টায় উঠতাম আর সোনালি ব্যাংকের কোন লন্ডন শাখা যদি থাকে সেটা!!
এখন যখনই বাবার কথা খুব মনে হয়, তখন আমার সেই সোনার মেডেলটা বের করে দেখি। হয়তো বা সেদিন বাবাকে গর্বিত করতে পেরেছিলাম হয়তো বা না!! কিন্তু এই সোনার মেডেল আমাকে সবসময় গর্বিত করে, ভালো ফলাফলের জন্য নয়, বাবার আদরের মেয়ে হয়ে জন্মাবার জন্য !!
ভালো থেকো আব্বু !!
তোমাকে প্রতিদিন মনে পড়ে !!
লেখিকা: শায়লা শারমিন। যুক্তরাজ্য প্রবাসী লেখিকা। [লেখাটি ফেসবুক গ্রুপ পেন্সিল এর সৌজন্যে]