জেন-জেড প্রজন্ম ও সোনালী সম্ভাবনা!

জেন-জেড প্রজন্ম ও সোনালী সম্ভাবনা!

মনোয়ার রুবেল:

বাংলাদেশে ব্যাংক খাতে সেবা ডিজাইন করা হয় সাধারণত ৫৫ থকে ৭৫ বছর বয়স্ক গ্রাহককে কেন্দ্র করে। যুক্তরাষ্ট্রে এই গ্রাহক শ্রেনীকে বলা হয় ‘বেবি বুমারস’। ১৯৪৪-১৯৬৪ এর মধ্যে যাদের জন্ম হয়েছে তাদের ‘বেবি বুমারস’ বলা হয়। বিশ^যুদ্ধের ভয়াবহতায় বিশৃঙ্খল পৃথিবীতে এক ঝাঁক শিশু এসেছিল। প্রতিকী নামে তাদের বেবি বুমারস নামকরণ করা হয়। একইভাবে ১৯৬৫-১৯৭৯ পর্যন্তÍ সময়ে যাদের জন্ম তাদের জেন-এক্স বলা হচ্ছে এবং ১৯৮০-১৯৯৪ পর্যন্ত সময়ে যারা জন্মেছেন তাদেরকে জেন-ওয়াই বলা হচ্ছে। সর্বশেষ প্রজন্ম অর্থাৎ ১৯৯৫ সালের পর যারা জন্মগ্রহণ করেছেন তারা হচ্ছেন ‘জেনারেশন জেড’ বা ‘জেন-জেড’। সম্পর্কের দিক দিয়ে জেন-জেড হচ্ছে জেন-এক্স এর পুত্র বা কণ্যা। বাংলাদেশে জেন-জেড হচ্ছে মোট জনসংখ্যার ২৭.২৯ শতাংশ, সংখ্যার হিসেবে প্রায় ৫ কোটি !!! মজার বিষয় হচ্ছে শতাংশের হিসাবটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় কাছাকাছি।

বিশ^ব্যাপী বিপণন দুনিয়া কিংবা বিনোদন দুনিয়া, সর্বক্ষেত্রে জেন-জেডকে লক্ষ্য করেই বাজার গবেষণা হচ্ছে। আধুনিক বিপননে বাজার ধরে রাখার পাশাপাশি ভবিষ্যৎ বাজার বিস্তৃত করা, কমপক্ষে বর্তমান বাজার ধরে রাখার দিকে চোখ রাখছে কোম্পানীগুলো। বৃহৎ ব্যাংকিং গোষ্ঠীগুলো কোটি ডলার ব্যয় করছে জেন-জেডের রুচি-অরুচি, পছন্দ-অপছন্দ জানতে। জেন-জেডের মনস্তত্ব নিয়ে জরিপ চালাচ্ছে বৃহৎ বিপননকারী প্রতিষ্ঠানগুলো। বাংলাদেশে অতো বিস্তারিত ভেবে ব্যাংকিং সেবা ডিজাইন করা না হলেও যুক্তরাষ্ট্র বা ইউরোপে ব্যাংকগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু এখন জেন-জেড।  এরা আগামী দিনের গ্রাহক।

 

জেপি মর্গান এর টার্গেট কেন জেন-জেড?

বিশ^খ্যাত ব্যাংকিং গ্রæপ জেপি মর্গান এন্ড চেজ। তাদের প্রকাশিত ‘আর্নিংস রিলিজ ফাইন্যান্সিয়াল সাপ্লিমেন্ট, জুন ২০২১’ এর হিসেব মোতাবেক জেপি মর্গান এন্ড চেজ বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের সর্ববৃহৎ ব্যাংক এবং বাজার মূলধনের ভিত্তিতে বিশে^র বৃহত্তম ব্যাংক। যুক্তরাষ্ট্রের প্রাচীনতম এই ব্যাংেেকর সহযোগী প্রতিষ্ঠান মর্গানস্ট্যানলি ২০১৮ সালে প্রজন্মভিত্তিক একটি ব্যাংকিং জরিপ চালিয়েছিল। তাদের জরিপে বলা হয়, “যদিও পরবর্তী দশকে ’মিলেনিয়াল’রা ব্যাংক খাতের প্রধান গ্রাহক হবে তা সত্বেও জেন-জেডই ব্যাংকগুলোর মূল লক্ষ্যে থাকবে”। জেন-এক্স এর সবচেয়ে কনিষ্ঠ প্রজন্ম ও জেন-ওয়াই প্রজন্মকে যৌথভাবে ‘মিলেনিয়াল’ বলা হয়ে থাকে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে পারিবারিক কাঠামো পরিবর্তনের প্রবণতা, বয়স ও আয়ের প্রবৃদ্ধিতে ভোক্তা ঋণ গ্রহণের প্রবণতা নিয়ে এই গবেষণায় দেখা দেখা গিয়েছে বর্তমানে মিলেনিয়ালরাই নতুন ঋণের বৃহত্তম অংশীজন। মর্গানস্ট্যানলি এর প্রধান, আমেরিকান অর্থনীতিবিদ এলেন জেনথার মতামত দিয়েছেন, বেবি বুমার’সরা যেভাবে ব্যাংক খাতে প্রবৃদ্ধি এনে দিয়েছিল পরবর্তীতে জেন-এক্স তা করতে পারেনি। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধ পরবর্তী বিশ^ ব্যাংকিং সেক্টরে যে ¯ফীত বাণিজ্য ঘটেছিল পরবর্তী প্রজন্মে সেই প্রবৃদ্ধি টিকে থাকেনি। এর কারণ নতুন উদ্যেক্তা সংকট ও প্রজন্মান্তরে ঝুঁকি নেয়ার পশ্চাদপদতা। স্বাভাবিকভাবে জেন-এক্স এর হতাশাজনক বাণিজ্য সংকোচন হতে উত্তরণে জেন এক্স পরবর্তী মিলেনিয়ালদের দিকেই বাজার গবেষকরা চোখ রেখেছেন। তাদের মনস্তত্ব বোঝার চেষ্টা করেছেন। প্রশ্ন উঠেছিল, মিলেনিয়ালরা এই মন্দা কতোটা কাটাতে পারবেন? এই প্রশ্ন উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে মর্গানস্ট্যানলি। তাদের গবেষনা বলছে, সেটা বড়জোর ৪% প্রবৃদ্ধি হতে পারে। নিঃসন্দেহে এটাও আশাজনক কোন পরিসংখ্যান নয়, তাই তাদের লক্ষ্য জেন-জেড বা জেনারেশন জেড।

 

জেন-জেড সম্পর্কে কতোটা জানা যায়?

জেন-জেড হচ্ছে প্রথম সামাজিক প্রজন্ম যারা শৈশব থেকে ইন্টারনেট এবং পোর্টেবল ডিজিটাল প্রযুক্তিতে প্রবেশ সুবিধা (এক্সেস) নিয়ে বড় হয়েছে। তাই জেনারেশন জেড-এর সদস্যদের “ডিজিটাল নেটিভস” বলা হচ্ছে। কেউ কেউ এদের আই-জেন (ইন্টারনেট জেনারেশন)ও বলে থাকেন। পিউ রিসার্চ সেন্টার কাজ করেছে জেন-জেড এর মনস্তাত্বিক বিষয়াদি নিয়ে। তারা জানতে চেয়েছে আমরা মিলেনিয়ালরা তাদের সম্পর্কে যেমন ভাবি, তারা ঠিক তার কতটুকু, নাকি ভিন্নতর। পিউ রিসার্চ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি খ্যাতনামা থিঙ্ক ট্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠান। ২০১৮ সালে পরিচালিত তাদের গবেষনায় দেখা যায়, ১৩- ১৭ বছর বয়সীদের ৯৫% এর কমপক্ষে একটি স্মার্টফোনে প্রবেশ সুবিধা আছে এবং ৯৭% কমপক্ষে সাতটি প্রধান অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করেন।

এসব কিশোরদের প্রিয় অনলাইন গন্তব্যগুলির মধ্যে রয়েছে গুগল, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম বা হোয়াটস অ্যাপ। যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ৮৫ শতাংশ কিশোর বলছেন তারা ইউটিউব ব্যবহার করেন, ৭২ শতাংশ ইনস্টাগ্রাম ব্যবহার করেন এবং ৬৯শতাংশ  স্ন্যাপচ্যাট ব্যবহার করেন। পিউ রিসার্চ জরিপের আগে যুক্তরাষ্ট্রে সাধারণের ধারণা ছিল কিশোররা দিনের বেশিরভাগ সময় ফেসবুকিং করে কাটায়। জরিপে অবাক করার মতো বিষয় হচ্ছে, মিলেনিয়ালদের তুলনায় জেন-জেডদের মধ্যে ফেসবুক অপেক্ষাকৃত কম জনপ্রিয়! ৫১% বলেছেন তারা এই সোশ্যাল মিডিয়া সাইট ব্যবহার করে দিনে দু’একবার।

মিলেনিয়ালদের মতো এই প্রজন্ম চাকুরিপ্রিয় হবেন নাকি উদ্ভাবনপ্রিয় হবে, তাদের পেশায়ই বা কি হতে পারে তার নিয়েও গবেষনা হচ্ছে। ব্যাংকার হিসেবে আমাদের আগ্রহের কেন্দ্র হবে নতুন প্রজন্ম কতোটা অর্থ সচেতন হবে তা নিয়ে? যুক্তরাষ্ট্রের আরেকটি প্রতিষ্ঠান র‌্যাডন রিসার্চ গবেষনা করেছেন এসব বিষয়াদি নিয়ে। তাদের জরিপে অংশগ্রহনকারী সকলেই ছিল কিশোর ও শিক্ষার্থী, বলাই বাহুল্য। গবেষনা দলে মুখোমুখি হওয়ার আগে তাদের কেউ আর্থিক বিষয়ে কোন ক্লাশ বা লেকচারে অংশগ্রহণ করেনি। তবু তাদের ৪৩ শতাংশ বলেছে কিভাবে সঞ্চয় করা যায় তারা তা শিখতে চায়। ৩৮ শতাংশ তারা জানতে চায় কিভাবে হাতখরচ কমানো যায়। চমকপ্রদ বিষয় হচ্ছে, কিশোরদের ৩৬ শতাংশ জানতে চায় আয়কর জিনিসটি কী, কিভাবে আয়কর দেয়া হয় তা নিয়ে। র‌্যাডন রিসার্চ ১৬-১৯ বছর বয়সী ২৮৯২ জন কিশোর কিশোরীর উপর এই জরিপ চালিয়েছিল। তাদের জরিপের শিরোনাম ছিল: ”জেন জেড: একটি টাচস্ক্রীন জেনারেশন”।

 

“জেড-কে জুম করুন”

আমরা মোবাইলে বা কম্পিউটারে ছবি বা ইমেজের কোন বিন্দু যখন গভীর তীক্ষèতায় দেখতে চাই তখন তা জুম করি অর্থাৎ বড় করে নিই এবং সেই নির্দিষ্ট বিন্দুতে ফোকাস রাখার চেষ্টা করি। বাজার বিশ্লেষকদের তরফে ব্যাংকগুলোকে বলা হচ্ছে, জেড’কে জুম করুন। জেন-জেডকে যতটা গভীরভাবে দেখা হবে ততই সম্ভাবনা অবারিত হবে।

প্রযুক্তি নির্ভর এই প্রজন্মের সাথে তাল মিলাতে আগামী দশকগুলোতে তাদের কেন্দ্র করেই যে ব্যাংকিং ব্যবস্থার পরিবর্তন আসবে বলার অপেক্ষা রাখেনা। বাংলাদেশ জেন-জেড কে কেন্দ্র্র করে স্কুল ব্যাংকিং সেবা ছাড়া আর কোন চোখে পড়ার মতো সেবা সাম্প্রতিক সময়ে নেই। স্কুল ব্যাংকিং এর মতো একই ধরণের একাউন্ট যুক্তরাষ্ট্রেও হচ্ছে। এসব একাউন্ট পরিচালনা করতে পিতামাতার স্বাক্ষরসহ অনুমতির প্রয়োজন হয়। মর্গানস্ট্যানলি এর ‘ব্যাংক এন্ড ডাইভারসিফাইড ফাইন্যান্স রিসার্চ’ এর প্রধান, বেটসি গ্র্যাসেক বলছেন, ”এই একাউন্টগুলো কিশোর ব্যবহারকারীদের তাদের বাজেট ও ব্যয় পর্যালোচনা করতে শেখায়”। ব্যাংকগুলোও কিশোরদের কাছে পোঁছুতে নানা ধরণের তৎপরতা চালাচ্ছে। মর্গানস্ট্যানলি এর রিপোর্ট বলছে, এই ধরণের প্রচেষ্টা আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে ব্যাংক ব্র্যান্ডকে এগিয়ে রাখবে। তবে বেটসি গ্র্যাসেক একই সাথে ব্যাংকগুলো চ্যালেঞ্জ নিয়েও কথা বলছেন। তিনি বলছেন, যখন এই সব কিশোররা ১৮ বছর পূর্ন হবে তখন ব্যাংকগুলো তাদেরকে এটা বোঝাতে যুদ্ধ করতে হবে, কিশোররা কেন সেই ব্যাংকটিকে শুধুমাত্র ব্যাক-এন্ড হিসেবে নয়, বরং তার প্রাথমিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেছে নিবেন। মিস্টার গ্র্যাসেক ব্যাক-এন্ড বলতে ‘শুধু ডেবিট-ক্রেডিট নির্ভর লেনদেন’ সেবাকে বুঝিয়েছেন।

জেন-জেড তার শৈশবের ব্যাংকের প্রতি শেষ পর্যন্ত কতোটা আস্থাশীল থাকবে সেটিও প্রশ্ন। তাদের নিরন্তর চাহিদা ও কৌতুহল মেটানোই ভবিষ্যতের ব্যাংকগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ হবে। বেটসি গ্র্যাসেক বলছেন, জেন-জেড গ্রাহক ধরে রাখতে, ব্যাংকগুলোকে কল সেন্টারে সর্বোত্তম গ্রাহক সেবা নিশ্চিত করতে হবে। ফোনকল ছাড়াই গ্রাহকদের অগুনিত প্রশ্নোত্তর ও চাহিদা মেটাতে পারে এমন প্রযুক্তি ও কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার প্রযুক্তিতে ব্যাংকগুলোকে বিনিয়োগ করতে হবে। গ্রাহককে কোনভাবে হতাশ হয় এমন কিছুই করা যাবেনা। প্রযুক্তির অবারিত সম্ভাবনার সাথে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ব্যাংকিং সেবার রুপচিত্র অঙ্কনই এখন ব্যাংকগুলোর গবেষনার অন্যতম বিষয়। আন্তার্জাতিক সাময়িকীগুলো জেন-জেডদের ভবিষ্যতের ব্যাংকিং কতোটা আধুনিক হবে তা নিয়েই বলছে।

 

বায়োমেট্রিক এখন প্রায় সেঁকেলে?

প্রশ্ন হয়, কেমন হতে পারে ভবিষ্যৎ ব্যাংক গ্রাহদের রুচি, পছন্দ বা অপছন্দ। তারা প্রযুক্তিনির্ভর, কিন্তু কী সেই প্রযুক্তি যার উপর ফিনটেক কোম্পানীগুলো বিশেষ নজর দিচ্ছে? এখন যে বায়োমেট্রিক প্রযুক্তির কথা বলা হচ্ছে সেটিই কি চূড়ান্ত ভবিষ্যৎ? সত্যি বলতে, এখন পর্যন্ত বলা হচ্ছে আগামী দশকগুলোতে কনজুমার ব্যাংকিং এ নেতৃত ¡দিবে বায়োমেট্রিক ব্যাংকিং। ফিঙ্গারপ্রিন্ট, ফেস রিকগনিশন, আইরিশ স্ক্যানিং ও ভয়েস রিকগনিশন; এই চার ধরণের বায়োমেট্রিক ব্যবস্থা বিশে^ এখন পর্যন্ত পরিচিত। জনপ্রিয়তায় এখন পর্যন্ত ফিঙ্গারপ্রিন্ট এগিয়ে। ব্যাংকিং বøগসাইটগুলো বলছে, এখন যেটাকে বায়োমেট্রিক ব্যাংকিং বলছি সেটি এখনো ভ্রæণস্তরে রয়েছে। মাত্র কয়েক বছর আগে, ২০১৯ সালে রয়েল ব্যাংক অব স্কটল্যান্ড তাদের কার্ডে ফিঙ্গারপ্রিন্ট সেবা যুক্ত করেছে। তাও একটি পাইলট প্রকল্প হিসেবে। প্রথম ব্যাংক হিসেবে যুক্তরাজ্যে ন্যাটওয়েস্ট মোবাইল অ্যাপস-এ ফিঙ্গারপ্রিন্ট যুক্ত করেছে। সিটি ব্যাংক ভয়েস অথেনটিকেশন, ব্যাংক অব আমেরিকার ৫টি চেইন ব্যাংক আইরিশ স্ক্যানিং নিয়ে কাজ করছে। বাংলাদেশ এক্ষেত্রে বিশে^র অনেক দেশ থেকে যথেষ্ট এগিয়ে বলতে হয়। এখানে এখন বায়োমেট্রিক নিয়ে ব্যাংকগুলো কাজ করছে। কয়েকটি ব্যাংক এজেন্ট ব্যাংকিং সেবায় বায়োমেট্রিক সুবিধা যুক্ত করেছে। বায়োমেট্রিক প্রযুক্তি একটি নিরাপত্তামূলক প্রযুক্তি, ফলে এটি ব্যাংকিংকে যতোটা নিরাপদ করেছে তার বিপরীতে গ্রাহকসেবা কতোটা বেড়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়।

 

ব্যাংক-ইন-এ বক্স

বলা হচ্ছে ব্যাংক-ইন-এ বক্স এর কথা। ব্যাংক-ইন-এ বক্স একটি এটিএম বুথ মনে হলেও এটি শুধু একটি এটিএম বুথই নয়, এর চেয়েও বেশী কিছু। এখানে যে মেশিনটি ব্যবহার করা হচ্ছে এটাকে বলা হচ্ছে ইন্টারএকটিভ টেলার মেশিন (আইটিএম)। আইটিএম মেশিন গ্রাহক ও ব্যাংকারের দূরত্ব কমিয়ে সেবা সুবিধা সহজতর করে। আইটিএম এর পদার্য় ভার্চুয়ালি একজন কাস্টমার সার্ভিস ম্যানেজার বা ব্যাংকার ভিডিওকলে উপস্থিত হয়ে গ্রাহকের অভিযোগ অনুযোগ শুনে সমাধান দেন। একই মেশিনে গ্রাহক নিজেই একাউন্ট খোলা, ঋণগ্রহণ, টাকা জমা, উত্তোলন করতে পারেন। টাচস্ক্রীনে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ও ডিজিটাল স্বাক্ষর দেয়ার ব্যবস্থাও থাকে। ২০১৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের টাওয়ার কমিউনিটি ব্যাংক প্রথম ব্যাংক-ইন-এ বক্স সেবা শুরু করেন।

জেন-জেডরা এমন ব্যাংকিংকে বলছেন ক্যাফে ব্যাংকিং। ক্যাফে ব্যাংকিং ব্যাংক-ইন-এ বক্স এর একটু বিবর্তিত ধারণা। পার্ক ব্যাংক, এনজে ২০১৬ সালে আইটিএম হতে একটু দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্য এনে এমন একটি শাখা খুলেছিল যে আপাতদৃষ্টিতে গ্রাহকের মনে হবে তিনি একটি কফি শপে এসেছেন। এখানে ভীড় নেই, হইচই নেই, কাউন্টারে পিসি বা আইপ্যাড আছে, ফ্রি ওয়াইফাই আছে এবং কফির ব্যবস্থা আছে। গ্রাহক ইচ্ছে করলে চা খেতে খেতে ভিডিওকলে একজন ব্যাংকার সাথে আলাপ করতে পারে। পার্ক ব্যাংক এনজে এতে চমৎকার সাড়া পায়।

এরপর সিটি ব্যাংক, ডাইম কমিউনিটি ব্যাংকসহ অনেক ব্যাংক এধারণায় উব্ধুদ্ধ হয়ে কিছু শাখা খোলে। বাংলাদেশেও একটি বেসরকারী ব্যাংক ২০২০ সালে আইটিএম/কিয়স্ক মেশিন স্থাপন করে। বিবিসি এক রিপোর্টে বলছে, ব্যাংক-ইন-এ-বক্স হবে নগদের আগামী ভবিষ্যৎ। তারা ব্রাজিল ও ভারতকে এ খাতে সম্ভাবনাময় বাজার হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

 

কার্ডবিহীন এটিএম বুথ

এখন যেভাবে প্লাস্টিক কার্ড ব্যবহার হচ্ছে আগামী দশকগুলোতে এমন কার্ড নাও থাকতে পারে। আপনার চেহারাই হয়ে যাবে আপনার কার্ড। হিসাব খোলার সময় আপনি আপনার চেহারা স্ক্যান করে নেয়া হবে। আপনি এটিএম বুথে ডিসপ্লের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে আপনার চেহারা স্ক্যান করে আপনার একাউন্ট ডিটেইলস এক্টিভ হবে। কোন পিন লাগবেনা, কার্ড লাগবে না। আপনি যতক্ষণ সামনে থাকবেন বুথ সাইন ইন অবস্থায় থাকবে। আপনি সরে গেলে সাইন আউট হয়ে যাবে। বিশ্বের কয়েকটি ব্যাংক বর্তমানে এটি পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে।

 

ইন্টারন্যাশনাল নন ব্যাংকিং ওয়ালেট

ইন্টারন্যাশনাল ওয়ালেট ব্যাংকিং এর কথা এখন সবার ধারণার মধ্যেই। বাংলাদেশ থেকে বসে ওয়ালেট হিসাবখুলে যে কেউ লেনদেন করতে পারবে পৃথিবীর যে কোন দেশে। এর জন্য ব্যাংক হিসাব থাকা লাগেনা। এই ধারনাটি আমাদের চোখের সামনে আছে। কিন্তু নিকট ভবিষ্যতে এই খাত চলে যেতে পারে নন ব্যাংকিং দেশী বা বহুজাতিক কোম্পানীগুলোর হাতে।বহুজাতিক কোম্পানীয় ওয়ালেটের বড় ঝুঁকি হচ্ছে ফরেন কারেন্সী হাত ছাড়া হওয়ার আশঙ্কা। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের জন্য কারেন্সী পাহারা দেয়াই বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাড়াবে তখন।

বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর এর জন্য নন-ব্যাংকিং ওয়ালেট বড় প্রতিযোগী হয়ে উঠতে পারে। গ্রাহক ডিপোজিটের বড় অংশই থাকবে ওয়ালেটে। আর্থিক ওয়ালেট ছাড়া বিপণণ সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ালেটও বড় প্রতিযোগী হয়ে উঠবে, আমাজান, আলিবাবার মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ালেট বা ডিসকাউন্ট একাউন্টে বড় পরিমান সঞ্চয় যুক্ত হবে। এসব অর্থ এক প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তরের সুবিধাও যুক্ত হতে পারে। ওয়ালেটে তরল টাকা লাগবেনা, ভল্ট লাগবে না।মোবাইল আর একটি এপস হাজার হাজার ডলার পাহারা দিবে। কিছু ওয়ালেট প্লাস্টিক এটিএম কার্ড সরবরাহ করছে। ভবিষ্যতের ব্যাংকগুলোর জন্য বড় অসুবিধা হবে এসব ওয়ালেটের সাথে আপোষরফা করা। তাই আগে থেকেই ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ধরনের ওয়ালেট সুবিধা তাদের সেবা লাইনে যুক্ত করছে। এসব ব্যাংকিং ওয়ালেটে ভবিষ্যতে বিপনন সাইটগুলোর ওয়ালেট সুবিধা যুক্ত হতে পারে।

 

ক্রিপ্টোকারেন্সির যুগ ও ব্যাংক খাতে সোশ্যাল মিডিয়ার অনুপ্রবেশ

 

ফেসবুক কিছুদিন আগেও লিব্রা নামে ই-মুদ্রা দিয়ে ব্যাংকিং সেবা আনতে চেয়েছিল। আপাতত সেটা ঠেকানো গিয়েছে বটে। কিন্তু নিকট ভবিষ্যতে কতদিন ঠেকিয়ে রাখা যাবে সেটিও প্রশ্ন। তাই যদি হয়, ভবিষ্যতের ব্যাংকিং সেবা চলে যাবে সোশ্যাল মিডিয়ার হাতে। জেন-জেড প্রজন্ম এমনিতেই সোশ্যাল মিডিয়ার অনুরক্ত। তাই যদি হয় হোয়াটস অ্যাপ, ইমো, স্কাইপে, টিন্ডার, আমাজান, ফেসবুক, টুইটার ভবিষ্যতে এরাই হতে যাচ্ছে অর্থ আদান-প্রদান এর নতুন ক্ষেত্র। ফেসবুক বা ইমো একাউন্ট হবে নতুন ব্যাংক একাউন্ট। সেখানে যুক্ত থাকবে মানি ওয়ালেট। তখন এক ফেসবুক একাউন্ট থেকে অন্য একাউন্টে টাকা পাঠাতে পারবেন, এজেন্ট এর কাছ থেকে ক্যাশ আউট করাতে পারবেন।

এসব সুবিধা এখনো সম্ভাবনার পর্যায়ে রয়েছে। যদি সম্ভাবনার ভ্রæণ বিকশিত হয় তবে পুরো ব্যাংকিং সেবাই প্রচলিত ব্যাংকারদের হাতের নাগালের বাইরে চলে যাবে? অথবা এমনও হতে পারে ব্যাংকই ভবিষ্যতের ই-মুদ্রার ব্যবস্থার প্রধান নিয়ন্ত্রক হবে। বিদেশী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো বসে নেই, তারা ভবিষ্যতের এই অদৃশ্যমুদ্রাকে কিভাবে নিয়ন্ত্রন করবে তা নিয়ে নিত্য গবেষনা করছে।

 

 

দিগন্তের আলোয় মেটাভার্স …

প্রযুক্তির সর্বাধুনিক সম্ভাবনার নাম হচ্ছে মেটাভার্স। মেটাভার্স হচ্ছে এমন একটি প্রযুক্তি ধরুন আপনার বন্ধুরা কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে ঘুরতে গিয়েছে এবং আপনি ভিডিও কলে তাদের সাথে কথা বলছেন। মেটাভার্স আপনাকে শুধু ভিডিও সুবিধাই দিবে না বরং আপনার মনে হবে আপনি কক্সবাজার সৈকতে তাদের সাথে আছেন, মেটাভার্স আপনাকে সেই অনুভূতি এনে দিবে। অনুভূতি এতোটা প্রখর হবে, মনে হবে সমুদ্র জলে এই বুঝি আপনিও ভিজে গেলেন। সম্প্রতি ফেসবুক মেটাভার্স প্লাটফর্ম নিয়ে কাজ করার ঘোষণা দিয়েছে।

প্রযুক্তি যখন মেটাভার্সের ¯্রােতে গা ভাসাবে তখন ব্যাংক বসে থাকবে তা কিন্তু না। কোরিয়ান ব্যাংক কে. ব্যাংক ইতিমধ্যে ব্যাংকে মেটাভার্সের প্রয়োগ নিয়ে পরীক্ষামুলক কাজ শুরু করেছে। কে ব্যাংক কোরিয়ান টেলিকমিনিকেশন কোম্পানী কেটি কমিউনিকেশনের একটি প্রতিষ্ঠান। তারা জুলাই ২০২১ সালে মেটাভার্স প্লাটফর্মে একটি “ভার্চুয়াল অর্থ শহর” তৈরী করেছে। ভার্চুয়াল এ ‘শহরে” তিনটি কেন্দ্র রয়েছে; অর্থ ও বাণিজ্য কেন্দ্র, টেলিকেন্দ্র ও প্লেগ্রাউন্ড। অর্থ বাণিজ্য কেন্দ্রের অধীনে মেটাভার্স শাখা চালুর পরীক্ষা নিরীক্ষা করছে। মেটাভার্স ব্যাংকিং নিয়ে কোরিয়ান ব্যাংকগুলো ব্যাপক গবেষণা করছে। কোরিয়ান ব্যাংক হান্নাহ, উরি, কুকমিন মেটাভার্স শাখা খোলার উদ্যেগ নিয়েছে। কোরিয়ান সরকারের উদ্যেগে স্যামস্যাং, হুন্ডাই, নেভারল্যাব-সহ ২০০ প্রতিষ্ঠান মিলে মেটাভার্স এলায়েন্স গঠন করা হয়েছে। সম্প্রতি মেটাভার্স প্রযুক্তিতে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ব্যাংকিং নেটওয়ার্ক ভিসা দেড়লাখ ডলার বিনিয়োগ করেছে। মেটাভার্স প্রযুক্তি এখনো সম্ভাবনার স্তরে আছে মাত্র। এখন যা মেটাভার্স বলা হচ্ছে ভবিষ্যতের কল্পিত মেটাভার্স তার থেকে অনেক উন্নততর হবে।

 

বাংলাদেশ কতোটা প্রস্তুত…

বিভিন্ন খাতের ডিজিটালাইজেশনের তুলনায় বাংলাদেশে ব্যাংকিং অনেক এগিয়ে। এর কারণ, ক্রমবর্ধমান শিক্ষার হার ও জনগনের জীবনমানের উন্নয়নে জনগণের প্রাণান্তকর চেষ্টা। সরকারী উদ্যেগ ও পাশাপাশি এদেশের ব্যাংক-প্রযুক্তিখাতে বিদেশী বিনিয়োগ ফিনটেক-এ বাংলাদেশকে এগিয়ে রেখেছে। বায়োমেট্রিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের প্রায় সময়সাময়িক বছরে বাংলাদেশ তা নিয়ে কাজ করা শুরু করেছে। এদেশে এখন অ্যাপসভিত্তিক ওয়ালেট সেবা, মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস এমনকি হালের ব্যাংক-ওয়ালেটও তুমুল জনপ্রিয়। সোনালী ব্যাংক লিমিটেড ইওয়ালেট, ইসেবা, সোনালী পেমেন্ট গেটওয়ে, ডুয়েল কারেন্সী কার্ড ইত্যাদি সেবা লাইনে যুক্ত করেছে।  দেশের পাঁচ কোটিরও বেশী প্রযুক্তি নির্ভর জেন-জেড প্রজন্ম ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির কৌতুহলী গ্রাহক। উদ্যেক্তা হিসেবের তাদের আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুও প্রযুক্তি।  ভবিষ্যতে যারা প্রযুক্তিতে যত এগিয়ে থাকবে তারা জেন-জেড গ্রাহকের প্রিয় ব্র্যান্ড ও ব্যাংক হয়ে উঠবে।  জেন-জেড ও প্রযুক্তিই আগামীর ব্যাংকিং ভবিষ্যৎ।

 

লেখক:

মনোয়ার রুবেল

                                                                                 

তথ্যসূত্র:

:: দ্যা ফোর্বস, জেন-জেড ও ব্যাংকিং বিষয়ে মর্গানস্ট্যানলি এর রিসার্চ পেপার, পিউ রিসার্চ ফাউন্ডেশন জরিপ রিপোর্ট, বিবিসি, টাইমস অব ইন্ডিয়া, কোরিয়া টাইমস, টাইম ম্যাগাজিন, উইকিপিডিয়া ও বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো।